সম্পাদকীয়
যশোর, ঝিনাইদহ ও নড়াইলে তিনটি আসনে ছাড় দিয়েছে বিএনপি। ফ্যাসিবাদবিরোধী দীর্ঘ লড়াইয়ে যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গে থাকা দলগুলোকে ছাড় দেওয়া হবে—বিএনপি একথা আগেই নিশ্চিত করেছিল।
সেই ঘোষণামতো দেশের সবচেয়ে বড় দলটি এখন পর্যন্ত মাহমুদুর রহমান মান্না, জোনায়েদ সাকি, নুরুল হক নুর, রাশেদ খান, মোস্তফা জামাল হায়দার, সাইফুল হক, ববি হাজ্জাজ, মুফতি রশীদ বিন ওয়াক্কাস প্রমুখ নেতাকে আসন্ন নির্বাচনে ছাড় দিয়েছে। গণঅধিকার পরিষদ, নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম প্রভৃতি রাজনৈতিক দল এদেশের রাজনীতিতে ‘ছোট দল’ হিসেবে পরিচিত। তবে এসব দলের নেতাদের অনেকেরই দেশজুড়ে পরিচিতি আছে। কোনো কোনো নেতার জানা-বোঝা ও ব্যক্তি ইমেজও যথেষ্ট ভালো। কিন্তু ভোটে জেতার জন্য যে জনভিত্তি প্রয়োজন, দলগুলোর তা নেই। এসব নেতার উপস্থিতি নিঃসন্দেহে জাতীয় সংসদের ঔজ্জ্বল্য বাড়ায়।
এবারের নির্বাচনে সংশোধিত আরপিও অনুযায়ী প্রার্থীদের নিজ দলের মার্কা নিয়ে লড়তে হবে। ফলে বেশ খানিকটা বিপাকে আছেন ছোট দলের এসব বড় নেতা। পরিস্থিতি বুঝে কোনো কোনো নেতা নিজ দল বিলুপ্ত করে ‘বড় দল’ বিএনপিতে যোগ দিচ্ছেন। আবার কোনো কোনো নেতা নিজ দলের প্রতীক নিয়েই নির্বাচন করতে চান। অবশ্য যেসব দলের নিবন্ধন নেই তাদের ক্ষেত্রে এই জটিলতা নেই। বিএনপির ছাড় পেলে তারা ধানের শীষ প্রতীক নিয়েই নির্বাচন করতে পারবেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতা একটি বড় সমস্যা। উদারতার বড় অভাব এখানে। এর খেসারতও রাজনীতিক তো বটেই সাধারণ মানুষকেও দিতে হয়েছে। ছোট শরিকদের মূল্যায়নে বিএনপি যে উদারতা দেখাচ্ছে—তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। অবশ্য এলডিপিসহ কোনো কোনো দল প্রত্যাশা অনুযায়ী আসন পায়নি বলে অভিযোগ এনে এককভাবে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে। ঘোষণা সত্ত্বেও পর্দার অন্তরালে যে সমঝোতাচেষ্টা হচ্ছে না—একথা জোর দিয়ে বলা যায় না।
জোটবদ্ধ রাজনীতি বা ভোটের আগে নির্বাচনি জোট গঠনের ইতিহাস বাংলাদেশের জন্মের চেয়েও পুরনো। এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক—দুই ধরনের প্রভাবই রয়েছে। একটি রাজনৈতিক দল গঠন হয় সুনির্দিষ্ট নীতি-আদর্শ-কর্মপরিকল্পনা নিয়ে। ভোটের মাঠে সুবিধা অর্জনের জন্য সেই দল বিলুপ্ত করা এক ধরনের নীতিবিবর্জিত কাজ। আবার রাজনৈতিক দলের নামে ‘ছোট ছোট দোকান’ খুলে দেশের কোন মঙ্গল সাধন করা যায়—সে প্রশ্নও সঙ্গত।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট ও পরে মহাজোট গঠনের কুফল আমরা দেখেছি। প্রথমত, কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠায় সংখ্যার বিচারে ‘অনেক দল’ আওয়ামী লীগের সহযাত্রী হয়েছে—যা দেশকে শেষাবধি অন্ধকারে নিয়ে গেছে। হাসিনার পলায়নের পর সেইসব সহযাত্রীদের এখন করুণ দশা। এদের মধ্যে বেশ কয়েকটি পার্টিকে মানুষ ‘আদর্শভিত্তিক দল’ হিসেবে মূল্যায়ন করতো। ওই সব দল অবয়বে ছোট হলেও সমাজে তাদের বক্তব্যের গুরুত্ব ছিল। দলগুলোর আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য বহু তরুণ জীবন দিয়েছে। সেই দল ও তার নেতাদের পচনদশা শেষ বিচারে জনগণের মধ্যে ‘আদর্শভিত্তিক রাজনীতি’ নিয়েই প্রশ্ন তোলে।
যাই হোক, যে আসনগুলোতে বিএনপি আন্দোলনের শরিকদের জন্য ছাড় দিয়েছে, সেখানকার কোনো কোনো মনোনয়নপ্রত্যাশী নির্বাচনে লড়বেন বলে ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন। এসব তৎপরতা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে লেজেগোবরে অবস্থা হবে। বিএনপির ডি ফ্যাক্টো সুপ্রিমো তারেক রহমান যেহেতু দেশে ফিরেছেন, এখন তিনি দলীয় শৃঙ্খলা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে উদ্যোগী হবেন বলে আশা করা যায়। তা না হলে বড় দলকেও ভবিষ্যতে বন্ধুহীন হওয়ার ঝুঁকিতে পড়তে হতে পারে।