সম্পাদকীয়
এখন থেকে প্রায় ১৭ বছর আগে তারেক রহমানকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিল ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিনের সরকার। শারীরিক নির্যাতনে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেওয়ার পর যে পরিস্থিতিতে তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়, তা ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে নজিরবিহীন। ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিনের ওই সরকার ‘সেনা সমর্থিত ওয়ান-ইলেভেনের সরকার’ হিসেবে সমধিক পরিচিত। নির্মম পরিহাস—তারেক রহমান রাজসিক সংবর্ধনা নিয়ে দেশে ফিরলেন, আর ফখরুদ্দিন আহমদ ও জেনারেল মইন উ আহমেদ বিদেশ-বিভূঁইয়েও জনরোষে পড়ার ভয়ে জনসমক্ষে আসতে পারেন না। এমনই হয়, এমনই হওয়ার কথা।
ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিনের শাসনের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’। সেসময় দেশের দুই প্রধান নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার যে প্রক্রিয়া কতিপয় সেনা কর্মকর্তা ও তথাকথিত সুশীলদের উদ্যোগে পরিচালিত হচ্ছিল, তা সফলই হয়ে যেত, যদি তারা খালেদা জিয়াকে সম্মত করাতে পারতো। কিন্তু ‘আপসহীন নেত্রী’ বলে কথা! শেখ হাসিনা কারামুক্ত হয়ে তড়িঘড়ি দেশ ছাড়লেও খালেদা জিয়া রাজি হলেন না। রাজনীতির মাঠে টিকে থাকতে শেখ হাসিনা আবার তড়িঘড়ি ফিরে এলেন দেশে। ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ মাঠে মারা গেল। শেখ হাসিনার সন্তানসহ বেঁচে থাকা নিকটজনরা আগে থেকেই বিদেশে থাকতেন। কিন্তু বেগম জিয়ার দুই সন্তান দেশেই ছিলেন। ফলে তার জন্য দেশের মাটি কামড়ে পড়ে থাকার সিদ্ধান্ত ছিল ভীষণ কঠিন। এবং এই কঠিন কাজটিই করলেন তিনি।
একথা এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে, ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল দেশকে সম্প্রসারণবাদী প্রতিবেশির পদতলে সমর্পণ করা। দুই সন্তানের জীবন বিপন্ন হওয়ার উপক্রম হলেও (পরে ছোট ছেলে মারাই যান) বেগম জিয়া যে দৃঢ়তা দেখিয়েছিলেন, তা তার গভীর দেশপ্রেমের সাক্ষ্য বহন করবে অনন্ত কাল।
প্রথম টার্গেট মিস হলেও লেগেপড়ে ছিল কুচক্রীরা। তারা ‘বিরূপ’ খালেদা জিয়াকে বাদ রেখে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নেয়। তার ফল হয়েছিল দেশে দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী শাসন। এমতাবস্থায় অনেকে ধরেই নিয়েছিলেন, সহসা এই দেশের মানুষের মুক্তি মিলছে না। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি দীর্ঘ লড়াই করেও হটাতে পারেনি মাফিয়া শাসকদের। তবে তারা মাফিয়াচক্রকে ‘দেশের শত্রু’ হিসেবে জনগণের সামনে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে দারুণ সফলতার পরিচয় দিতে পেরেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ছাত্র নেতৃত্বাধীন আন্দোলন শুরু হলে তাতে যোগ দেয় লাখ লাখ মানুষ এবং পরিণতিতে শেখ হাসিনাকে পালিয়ে যেতে হয়।
জাতির ঘাড় থেকে জগদ্দল পাথর নেমে যাওয়ায় সৃষ্ট অনুকূল পরিবেশে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন বিএনপির ডি ফ্যাক্টো প্রধান তারেক রহমান। ২৫ ডিসেম্বর তাকে যেভাবে মানুষ বরণ করে নিল, দেশের ইতিহাসে এমনটি আর দেখা যায়নি কখনও। দেশে ফিরেই লাখ লাখ মানুষের সামনে তারেক রহমান ‘শান্তি ও ইনসাফের বার্তা’ দিলেন।
তারেক রহমানের এই বার্তা নানা কারণে মানুষকে আশাবাদী করে তুলেছে। দীর্ঘ কর্তৃত্ববাদী শাসনে নিষ্পেষিত মানুষের অধিকার বলতে কিছু ছিল না। তারা না পারতো ভোট দিতে, না পারতো নিজ মতামত প্রকাশ করতে। গুম-খুন, মামলা-হয়রানি চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল দুঃশাসনকে। একটি ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা একাত্তরে এবং চব্বিশেও মানুষের মনে জেগেছিল। একাত্তরে মানুষের সেই আকাক্সক্ষা উবে যেতে মোটেই সময় লাগেনি। চব্বিশের আকাঙ্ক্ষাও যখন ক্ষীণ হয়ে আসছে, তখন তারেক রহমানের এই আশার বাণী উজ্জীবিত করছে দেশবাসীকে।
আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে কোন দল জয়ী হবে, আমরা কেউ জানি না। তবে খালেদা জিয়া-তারেক রহমানের নেতৃত্বাধীন বিএনপির ক্ষমতাসীন হওয়ার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। মানুষ দেখতে চাইবে, তারেক রহমান তার কথা কতটা রাখতে পারলেন। ‘উই হ্যাভ আ প্লান’ নিশ্চয় শুধু কথার কথা না। কী পরিকল্পনা নিয়ে তিনি ও তার দল এগুচ্ছে ভোটের আগেই তা খোলসা করা হোক। আমরা আর কথার খেলাপ চাই না। যেকোনো মূল্যে দেশকে উন্নতি-প্রগতির পথে নিয়ে যেতে চাই। এক নদী রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা দেশ। তরুণ-যুবাদের খুনে রঞ্জিত রাজপথ এখনও মানসপটে ভাসছে। এই রক্ত কোনোমতে বৃথা যেতে পারে না, যেতে দেওয়া হবে না।
তারেক রহমানের নেতৃত্বে আগামীর বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা হোক ইনসাফের, হোক ন্যায়ের।