সরোয়ার হোসেন
মার্টিন লুথার কিং ছিলেন আমেরিকান-আফ্রিকান বংশোদ্ভূত মানবাধিকার কর্মী। ১৯৬৩ সালে ওয়াশিংটন অভিমুখে তার অভিযানের সময় দেওয়া ভাষণটি ইতিহাসে ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’ নামে পরিচিত। যেখানে তিনি মানুষে মানুষে ভেদাভেদের দেয়াল ভেঙে সাম্যের জয়গান গেয়েছিলেন। তার সেই বিখ্যাত ভাষণের ৬২ বছর পর ঢাকায় উচ্চারিত হলো ‘আই হ্যাভ আ প্ল্যান’। উচ্চারণ করলেন তারেক রহমান। তারেক রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তার আরও পরিচয় তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মেজর জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র। দীর্ঘ ১৭ বছর তিন মাস পর দেশে প্রত্যাবর্তনের প্রথম প্রকাশ্য জনসভায় সেই পরিকল্পনার কথা উচ্চারণ করেছেন তারেক রহমান। বলেছেন, বাংলাদেশ নিয়ে, বাংলাদেশের জনগণকে নিয়ে নিজের পরিকল্পনার কথা। পরিকল্পনাটি সবিস্তারে বর্ণনা না করলেও বুঝিয়ে দিয়েছেন সুন্দর আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণই হবে সেই পরিকল্পনার মূল কাজ। এই বাংলাদেশ হবে একাত্তরের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম আর চব্বিশের ফ্যাসিবাদবিরোধী চেতনায় সমৃদ্ধ এক সোনার বাংলাদেশ। যেখানে তিনি সকলের সহযোগিতা চেয়েছেন। বলেছেন, দেশে কোনো বিশৃঙ্খলা থাকবে না, ‘আমরা দেশের শান্তি চাই, আমরা দেশের শান্তি চাই, আমরা দেশের শান্তি চাই’।
তারেক রহমান যখন দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন তখন তিনি ছিলেন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তার শরীরে মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। বাথরুমে পড়ে গিয়ে মাথায় তীব্রভাবে আঘাত পেয়েছিলেন। তিনি বেঁচে ফিরবেন- সেই আশা করেননি অনেকে। কিন্তু, কথায় আছে না, ‘রাখে আল্লাহ মারে কে’। দীর্ঘ চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হয়েছেন। তারপরও দেশে ফিরতে পারেননি। একের পর এক সাজানো মামলায় তাকে আসামি করে ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকার। এরই মাঝে নির্যাতনের শিকার ছোটভাই আরাফাত রহমান কোকো মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন। তাকে শেষবারের মতো দেখতেও আসতে পারেননি। মা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া দীর্ঘ কারাবরণ আর তীব্র মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে গুরুতর অবস্থায় পতিত হয়েছেন। এই সময়ও মায়ের পাশে থাকতে পারেননি তিনি। তার দেশে ফেরার সকল রাস্তাই যাতে বন্ধ হয়ে যায় তার সব কায়কারবার করেছিল ফ্যাসিস্ট সরকার। শেষ পর্যন্ত গণমানুষের বিপুল আন্দোলনের তোড়ে এদেশ থেকে বিদায় নিয়েছে ফ্যাসিবাদ। পালিয়ে গেছেন পালের গোদাসহ তার চামুণ্ডারা। তারেক রহমানও সকল বাধা আর জল্পনাকে উপেক্ষা করে দেশের মাটিতে পা দিয়েছেন। এসেই দুই হাত প্রসারিত করে বিশাল জনসমুদ্রে ঘোষণা করেছেন বাংলাদেশ নিয়ে নিজের ভাবনার কথা।
মার্টিন লুথার কিং লড়াই করেছিলেন আমেরিকার মানুষের নাগরিক ও মানবাধিকার নিয়ে। বাসের সিটে কৃষ্ণাঙ্গদের বসতে না দেওয়ার মধ্য দিয়ে মার্কিন সমাজে বর্ণবাদের যে চেহারা প্রকট হয়ে উঠেছিল তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। ক্রমে সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে গোটা মার্কিন মুলুকে। অন্যান্য নাগরিক অধিকার তথা সার্বিক মানবাধিকার আন্দোলনের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরে পরিণত হন জুনিয়র কিং। মার্টিন লুথার কিং-এর সঙ্গে তারেক রহমানের ভাষণের সুরেই কি শুধু মিল? এক কথায় উত্তর ‘না’। তারেক রহমানও যে শাসকের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তারাও নিজের দেশের নাগরিকের মানবাধিকার ভূলুন্ঠিত করেছে। অধিকার খাতা-কলমে থাকলেও তার কোনো ছিটেফোঁটাও পায়নি দেশের মানুষ। কথা বলার কোনো স্বাধীনতা ছিল না। কিছু বললেই ‘ট্যাগ’ লাগিয়ে নির্যাতন, বিনা বিচারে আটক, অপহরণ, গুম, হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ পরিচালনা করা হয়েছে তার দলসহ ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর। যার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, সাংবাদিক। নির্যাতিত হয়েছে অধিকারকর্মীরা পর্যন্ত। সেই ফ্যাসিবাদের পতনের পর দেশে ফিরে সঙ্গত কারণেই মার্টিন লুথার কিংয়ের কণ্ঠনিসৃত বক্তব্যেরই পুনরাবৃত্তি করবেন তারেক রহমান- এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
তারেক রহমান দেশে ফেরার পর মুহূর্তেই পাল্টে যাবে দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট- এমন আভাস অনেকেই করেছিলেন। যারা বিএনপিকে এতোদিন কোণঠাসা করে রাখতে নানা ‘খেলা’ করেছেন তারা ম্রীয়মান হয়ে পড়বেন- এটিও ভেবেছিলেন বিশ্লেষকদের মধ্যে কেউ কেউ। তবে, এই কথা ‘ষড়যন্ত্রকারী’রা জানতেন না- এমনটি নয়। বরং তারা আরও ভালোভাবে জানতেন। সে কারণে তারেক রহমান যাতে দেশে ফিরতে না পারেন তার যাবতীয় আয়োজন করেছিলেন তারা। দেশে-বিদেশে বসে তার বিরুদ্ধে একের পর ষড়যন্ত্র আর প্রপাগান্ডার জোয়ার তুলেছিলেন এই গোষ্ঠী ও তাদের লেজুড়রা। কিন্তু, বিচক্ষণ যোদ্ধা হিসেবে তারেক রহমান নিজের গন্তব্যের প্রতি ছিলেন অবিচল। কোনো প্রপাগান্ডাই তাকে লক্ষ্যচ্যুত করতে পারেনি। বরং, চৌকস একজন রাজনীতিক হিসেবে প্রতিটি ষড়যন্ত্রেরই তিনি জবাব দিয়েছেন ঠান্ডা মাথায়। দলের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি মাঠের শৃঙ্খলা ধরে রাখতে সুদূরে বসে করেছেন নীবিড় পর্যবেক্ষণ। সে কারণে একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে দলের মধ্যে ঘটে যাওয়া অনেক বিষয়েই তিনি ওয়াকেবহাল থাকতেন। সে অনুযায়ী গ্রহণ করতেন পদক্ষেপ। একের পর কর্মসূচিতে ভার্চুয়ালি যুক্ত থেকে পুরো দলকে একই সূত্রে গেঁথে রাখার এই মন্ত্র তারেক রহমানকে দেশে না থেকেও দেশের রাজনীতির চালকের ভূমিকায় বসিয়েছে।
অবশেষে পূর্বানুমান সঠিক করেই দেশের রাজনীতির সকল ফোকাস নিজের দিকে টেনে দেশে ফিরলেন তারেক রহমান। তার দেশে ফেরার ঘোষণার পরপরই দ্রুতই বদলে যেতে শুরু করে দেশের রাজনীতির গতিপথ। সারাদেশেই বিএনপির নেতাকর্মীরা চাঙা হয়ে ওঠেন। কীভাবে বিপুল সংবর্ধনায় প্রিয় নেতাকে বরণ করবেন- তা নিয়ে চলে প্রতিযোগিতা। কোন জেলা থেকে কোন নেতার নেতৃত্বে বেশি কর্মীর সমাবেশ ঘটানো যাবে রাজধানীতে, তার রিহার্সেলও দেখা গেছে এই ক’দিন। মিছিলে মিছিলে মুখরিত হয়েছে প্রতিটি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, হাট-বাজার। সব আয়োজনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ২৫ ডিসেম্বর, তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে তাকে বরণ করে নেওয়া।
সেই বরণ এমন রাজসিক হয়েছে যে তাকে এক কথায় অভাবনীয়, অতুলনীয়, অসাধারণসহ নানা অভিধায় অভিহিত করা সম্ভব। তীব্র শীত উপেক্ষা করে লাখ লাখ মানুষের গগণবিদারী স্লোগানে মুখরিত এমন সুশৃঙ্খল স্রোত বান্দরবন থেকে সুন্দরবন, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া-দেশের প্রতিটি প্রান্ত থেকে রাজধানীর দিকে আছড়ে পড়েছে। এমন কোনো যানবাহন নেই, যা ব্যবহার হয়নি। এমনকী নেতাকর্মীরা পায়ে হেঁটেও গন্তব্যে পৌঁছেছেন। যুবক-তরুণ থেকে শুরু করে বয়োবৃদ্ধ- কেউই বাদ যাননি। যে যেভাবে পেরেছেন প্রিয় নেতাকে একনজর দেখার জন্য, বরণ করার জন্য বাড়ি ছেড়েছেন। যে তরুণ তারেক রহমান দেশান্তরিত হওয়ার পর ভূমিষ্ট হয়েছিল তার আবেগের সাথে জীবন সায়াহ্নে এসে পৌঁছানো মানুষটিরও আবেগের কম-বেশি নেই। সবারই এক আওয়াজ ‘তারেক জিয়া বীরের বেশে, ফিরছে এবার বাংলাদেশে’, ‘তারেক জিয়া আসছে, বাংলাদেশ হাসছে’।
সত্যিই বীরের বেশে দেশে ফিরেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তিনি যে সংবর্ধনা পেয়েছেন তা সত্যিকারের একজন বিজয়ী বীরের জন্য প্রাপ্য। সিলেট থেকে ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করার পর দলীয় নেতাদের সঙ্গে শুভেচ্ছাবিনিময় ও প্রয়োজনীয় আলাপ সেরে তিনি জনতার সমুদ্রে ভেসে সামান্য পথ পাড়ি দিতে যে সময় নিয়েছেন তা-ই বলে দেয় কত মানুষের সমাগম ঘটেছিল ঢাকায়। সেই জনসমুদ্রে ভেসেই তিনি মঞ্চে উঠে মার্টিন লুথার কিংয়ের নাম নিয়ে ঘোষণা করেছেন ‘আই হ্যাভ আ প্ল্যান’।
যারা বলছিলেন তারেক জিয়াই এই সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতির হৃদয়ের স্পন্দন, তারা ভুল বলেননি, বাড়িয়ে বা কমিয়ে বলেননি। তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়েই এটি প্রমাণিত হয়েছে। আগামী দিনের বাংলাদেশের গতিপথ যেন তারেক জিয়ার নেতৃত্বের দ্বারাই নির্ধারিত। তিনি জানেন, এখানে ভুল করার কোনো সুযোগ নেই। সে কারণে তিনি পরিকল্পনা করেই এসেছেন কীভাবে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। দেশের তরুণ-যুবাদের কর্মসংস্থান, নারী, প্রতিবন্ধী বা পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ উদ্যোগের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন তিনি। বলছেন, এই বাংলাদেশ সবার-ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোষ্ঠীনির্বিশেষে দেশের প্রতিটি মানুষ স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক। এই যোগ্যতা আমরা অর্জন করেছি একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে; ফ্যাসিবাদ যাকে সম্প্রসারণবাদের কাছে বিকিয়ে দিয়েছিল, চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তা পুনরুদ্ধার হয়েছে। এখানে কোনো দাড়ি, কমা বা নোক্তার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে একাত্তর আর চব্বিশের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে। সেই সিঁড়িতে ওঠার দৌড়ে আড়েবাড়ে খেলা রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে প্রতিযোগিতার আঁচ এখনই অনুভব করা যাচ্ছে।
লেখক: বার্তাপ্রধান, সুবর্ণভূমি