ভৈরবে নাব্য সংকট
স্টাফ রিপোর্টার
, যশোর ও অভয়নগর প্রতিনিধি
ভৈরব নদে নাব্য সংকট প্রকট আকার নিয়েছে। এর ফলে অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র যশোরের নওয়াপাড়া নদীবন্দর। নদের বুকে জেগে ওঠা বিশাল চর গুরুত্বপূর্ণ এই নৌ-বন্দরের কার্যক্রমে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে মুখ থুবড়ে পড়তে পারে এই অঞ্চলের হাজার কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নওয়াপাড়া নদীবন্দর-সংলগ্ন নতুন সেতু এলাকায় প্রায় আধা কিলোমিটার জুড়ে নদের দুই-তৃতীয়াংশই পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে। জোয়ারের সময়ও এখানে লাইটার জাহাজ, কার্গোসহ অন্যান্য নৌযান চলাচল কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে, আর ভাঁটার সময় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। বন্দরে পণ্যবাহী কার্গো জাহাজগুলো ভিড়তে না পেরে মাঝনদীতে আটকে থাকে দীর্ঘ সময়। ফলে আমদানি-রপ্তানিতে বিকল্প হিসেবে স্থলপথ ব্যবহার করতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। এতে পরিবহন খরচ বাড়ছে, যার প্রভাব পড়ছে পণ্যের দামের ওপর।
নওয়াপাড়ার সার ও কয়লা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান রায়হান এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজার উত্তম কুমার কুণ্ডু জানান, পলি জমার কারণে কার্গো জাহাজগুলো আগের মতো বন্দরে নোঙর করতে পারছে না। আগে দিনে ৩০ থেকে ৪০টি জাহাজ নোঙর করলেও বর্তমানে সে সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। এতে আমদানি ও রপ্তানির ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে।
তিনি বলেন, নদের নাব্য সংকটে সার্বিকভাবে হুমকির মুখে পড়েছে নওয়াপাড়া নৌবন্দর। ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি হুমকির মুখে পড়েছেন শ্রমিকরা। জাহাজের অভাবে বন্দরে নিয়মিত কমছে শ্রমিকের সংখ্যা।
শ্রমিকনেতারা বলছেন, কার্গো কমে যাওয়ায় আয় কমেছে শ্রমিকদের। ফলে অনেকেই অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন।
শ্রমজীবী সমন্বয় পরিষদ অভয়নগর শাখার সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মোল্লা হাফিজুর রহমান বলেন, শ্রমিকদের এখন আগের মতো উপার্জন নেই। আগে বন্দরে ছোট-বড় মিলিয়ে শতাধিক কার্গো নোঙর করতো। তবে বর্তমানে বড় কার্গোর সংখ্যা অনেক কমেছে। এতে শ্রমিকরা আগের মতো কাজ পাচ্ছেন না। আবার যে জাহাজগুলো ঘাটে আসছে সেগুলো ঘাট থেকে খানিকটা দূরে নোঙর করছে। এতে পণ্য লোড-আনলোডে ঝুঁকি বাড়ছে শ্রমিকদের। প্রায়শই ঘটছে দুর্ঘটনা।
বিগত পাঁচ বছর যাবত সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে বলে জানিয়েছেন নওয়াপাড়া সার সিমেন্ট ও খাদ্যশস্য ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহ জালাল হোসেন। তিনি বলেন, মূল সমস্যা নদের ওপর নির্মিত সেতুটি। এটি অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। যার ফলে স্বাভাবিক পানি প্রবাহে বাধা পড়ছে। দিন যত যাচ্ছে সেতুর আশপাশে চর বড় থেকে আরও বড় হচ্ছে।
দ্রুতই ভৈরব নদের এ অংশ মরা খালে পরিণত হবে বলে আশঙ্কা নওয়াপাড়ার ব্যবসায়ীদের এই গুরুত্বপূর্ণ নেতার।
নওয়াপাড়া সার ও খাদ্যশস্য ব্যবসায়ী সমিতির প্রচার সম্পাদক ও নওয়াপাড়া প্রেসক্লাবের সভাপতি এস এম মুজিবুর রহমান জানান, নৌ, সড়ক ও রেলপথের সুবিধা থাকায় নওয়াপাড়া দেশের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র। এখান থেকে বছরে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকার কয়লা, সার, খাদ্যশস্য ও পাথরসহ আমদানিকৃত পণ্য সারা দেশে যায়। এই পুরো বাণিজ্যই ভৈরব নদের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু পলি পড়ে নদটি এখন মুমূর্ষু।
নওয়াপাড়ার ব্যবসায়ী নূর আলম পাটোয়ারী বলেন, নাব্য কমে যাওয়ায় কার্গো জাহাজগুলো সঠিক সময়ে বন্দরে ভিড়তে পারছে না। এই সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে নওয়াপাড়ার ঐতিহাসিক ব্যবসা-বাণিজ্য হারিয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, এর সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার হ্যান্ডলিং শ্রমিকসহ লাখো মানুষ বেকার হয়ে পড়বে। ব্যবসায়ীরা পথে বসবে এবং সরকার হারাবে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব।
খুলনা নৌপরিবহন মালিক সমিতির কোষাধ্যক্ষ চৌধুরী মিনহাজ উজ জামান সজল বলেন, ‘দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সব থেকে বড় নদীভিত্তিক অর্থনৈতিক কেন্দ্র নওয়াপাড়া। নাব্য সংকট, পানি কমতে কমতে ভৈরব নদ আশঙ্কাজনকভাবে ছোট হয়ে আসছে। সঠিক পদ্ধতিতে ড্রেজিং করার প্রয়োজনীয়তার কথা আমরা বারবার বলেছি। তবে এর সমাধান হচ্ছে না।’
এই বিষয়ে নওয়াপাড়া নদীবন্দরের উপ-পরিচালক মো. মাসুদ পারভেজ বলেন, ‘শুষ্ক মৌসুমে নাব্য সংকট কিছুটা প্রকট হয়। তবে আমরা বসে নেই। বিআইডব্লিউটিএ-এর পক্ষ থেকে বর্তমানে চারটি ড্রেজার দিয়ে খনন কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে। নদের যেসব গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে পলি জমেছে, সেগুলো দ্রুত অপসারণের চেষ্টা চলছে। আশা করছি শিগগিরই জাহাজ চলাচলের স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসবে।’
তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, চলমান ড্রেজিং কার্যক্রম নদের বিশাল আয়তনের তুলনায় পর্যাপ্ত নয়। পরিকল্পিত এবং দীর্ঘমেয়াদী খনন কাজ না হলে দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র নওয়াপাড়া বন্দর অচল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে।