যশোরের সুখ্যাত খেজুরগুড়-পাটালি
গোলাম মোস্তফা
, যশোর
যশোরের খেজুরের গুড়-পাটালির সুখ্যাতি সুবিদিত। পৃথিবীর যেখানেই বাঙালির অবস্থান সেখানেই যশোরের খেজুরের গুড়ের প্রতি ভালোবাসার ঘাটতি নেই। তবে, অতিমুনাফালোভীদের কবলে পড়ে যশ হারাতে বসেছে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া যশোরের এই ঐতিহ্য।
যশোরের বাজারে খেজুরের গুড় হিসেবে যা বিক্রি হচ্ছে তার গুণগত মান নিয়ে যেমন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তেমনি এসব গুড় কতটা খেজুরের রস দিয়ে তৈরি অথবা রসের কত ভাগ যশোরের গাছে- তা নিয়েও রয়েছে সংশয়। বাজারে রস আর গুড়ের দামের তারতম্য থেকেও এটি বোধগম্য।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এবং সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়, বর্তমানে খেজুরগাছ কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে। পেশা পরিবর্তনের কারণেও অনেক গাছি এখন আর গাছ কাটেন না। সে কারণে গুড়ের উৎপাদন কমে গেছে। তারপরও অতি মুনাফালোভীদের হাত ধরে বাজার ভেজাল গুড়ে সয়লাব। যা খাওয়ার পর শরীরে কঠিন রোগ বাসা বাঁধতে পারে বলেও সতর্ক করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
ভেজাল গুড় ও পাটালি
প্রশাসনিক, রাজনৈতিক এবং অভিজাত মহলে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যম হিসেবে অনেকে যশোরের খেজুরের গুড়ের ব্যবহার করে থাকেন। জেলার বাইরে থেকে আসা অতিথি আপ্যায়ন বা তাদেরকে উপহার হিসেবে দিতে যশোরের খেজুরের গুড়ের জুড়ি মেলা ভার। শীত মৌসুমে খেজুরের গুড় ও রসের পিঠা, পায়েসের প্রতি রসনাবিলাসীদের আগ্রহ দেখা যায়। চিকিৎসকেরাও বলেছেন, খেজুরের রস ও গুড়ের স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে।
সংগত কারণে যশোরের খেজুরের গুড়ের জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। তবে, দিন দিন জৌলুস হারানো খেজুর গুড়ের হালহকিকত জানতে খবর নেওয়া হয়েছে সুবর্ণভূমির পক্ষ থেকে। দেখা গেছে, যশোরের বাজারে এক কেজি পাটালি মাত্র ১৪০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে। একটু দরদাম করলে এই গুড় আরো দশ টাকা কমে ১৩০ টাকায় কেনা সম্ভব, বলেছেন অনেকে। অথচ, এক ভাড় (ঠিলে) খেজুরের রস বিক্রি হচ্ছে সর্বনিম্ন ৪০০ টাকায়। চাষিরা জানিয়েছেন, এক কেজি পাটালি উৎপাদনে প্রয়োজন প্রায় দুই ভাড় রস, যার মূল্য ৮০০ টাকা। সেখানে ১৪০ টাকায় এক কেজি গুড় বা পাটালি পাওয়া প্রায় অসম্ভব, বলছেন গাছিরা।
যশোর বড়বাজারের গুড় বিক্রেতা সুমন স্টোরের মালিক সুমন জানান, তিনি একশ' টাকা কেজি দরে খেজুরের গুড় কিনে এনেছেন। এই গুড় তিনি বিক্রি করছেন ১৩০ টাকা কেজিতে।
সুমন জানান, তিনি যাদের কাছ থেকে গুড় কিনেছেন তারা সরাসরি গাছিদের কাছ থেকে ৮০ থেকে ৯০ টাকা কেজি দরে কেনেন।
যশোর বড়বাজারে পাটালি কিনতে আসা মণিরামপুর উপজেলার খেদাপাড়ার বাসিন্দা সঞ্জয় নন্দী নামে এক সাংস্কৃতিক কর্মীর সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি জানান, এক কেজি পাটালি উৎপাদনে গাছিদের সর্বনিম্ন খরচ ৬০০ টাকা।
‘গাছিবাড়ি’ নামে যশোরের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হিসেব মতে, এক কেজি খেজুরের গুড় তৈরি করতে খরচ হয় সাড়ে সাতশ’ থেকে আটশ’ টাকা। শ্রমিকের মজুরি, বাজারজাত করার খরচসহ সেই গুড় এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি করতে না পারলে গাছি সামান্য লাভের মুখ দেখতে পারবে না।
এই পরিস্থিতিতে একজন উৎপাদক কীভাবে ৯০ টাকা দরে পাটালি বিক্রি করে- এমন প্রশ্ন করলে ব্যবসায়ী সুমন সুবর্ণভূমিকে বলেন, ‘যশোরের পাটালির পাশাপাশি আমার কাছে উত্তরবঙ্গের উন্নত মানের পাটালিসহ সব ধরনের পাটালি আছে।’ অর্থাৎ যশোরের পাটালির নামে তিনি যা বিক্রি করছেন তা যে যশোরে উৎপাদিত না, তা-ই প্রমাণ হয়।
যশোর বড়বাজারের কুন্ডু ট্রেডার্স থেকে জানানো হয়েছে, তারা প্রতিদিন কয়েক মণ পাটালি বিক্রি করেন। তাদের কাছে ২০০ টাকা থেকে শুরু করে ৬০০ টাকা কেজি দরের পাটালি বা গুড় রয়েছে। এসব গুড়ের মান নিয়ে জানতে চাইলে দোকানির উত্তর, ‘ভেজাল কি না তা সঠিক বলতে পারবো না’। তবে, দামের কমবেশি থাকায় গুড় ভালো-মন্দ আছে বলে মনে করেন এই ব্যবসায়ী।
তিনি জানান, যশোরে চাহিদার তুলনায় গুড় উৎপাদন হয় না। সেই ঘাটতি পূরণ করেত উত্তরবঙ্গ থেকে প্রচুর পাটালি বা গুড় আসে যশোরে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাইরে থেকে আসা এসব গুড়ই যশোরের খেজুরের রস থেকে উৎপাদিত বলে চালিয়ে দেন ব্যবসায়ীরা।
আরিফ নামে আরেক ব্যবসায়ী জানান, তিনিসহ যশোর বড়বাজারে আটজন গুড় ব্যবসায়ী আছেন। এছাড়া, ফুটপাত, স্টেশন, বাসস্ট্যান্ডসহ বিভিন্ন সড়কের মোড়ে আরো প্রায় দুই ডজন ব্যক্তি গুড় বিক্রি করছেন। অধিকাংশ জায়গায় বিক্রি হচ্ছে ভেজাল গুড়।
বাঘারপাড়া উপজেলার ভাঙ্গুড়া গ্রামের আব্দুর রাজ্জাকের স্ত্রী কলেজশিক্ষক হোসনে আরা খাতুন তার মেয়ের জন্য এবছর এখনো পাটালি কিনে দেননি। খাঁটি পাটালি কিনবেন বলে বিভিন্ন দোকানে ঘুরছিলেন তিনি। এক পর্যায়ে তিনি জানান, তার মেয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। গত বছর পাটালি খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল সে। শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছিল তাকে।
তিনি আরো বলেন, যেভাবে পাটালি বা গুড়ে ভেজাল দেওয়া হচ্ছে তাতে শিশুদের খাওয়ানো বন্ধ করে দিতে হবে। তিনি প্রশাসনকে ভেজাল গুড় তৈরি ও বিপণনের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।
চৌগাছা উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের বাদেখানপুর গ্রামের গাছি মোতালেব হোসেন জানান, এক কেজি পাটালি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়। তাতে খরচ ও মজুরির দাম ওঠে না। বাধ্য হয়ে অনেক গাছি রসের মধ্যে চিনি মিশিয়ে বেশি গুড় তৈরি করছেন। প্রায় ১০ থেকে ১১ লিটার রস জ্বাল দিলে এক কেজি গুড় হয়।
একই তথ্য দেন মণিরামপুর উপজেলার মাছনা খানপুর গ্রামের আলী রেজা। তিনি জানান, এক সময় তাদের শতাধিক খেজুরগাছ ছিল। কিন্তু, গাছিরা উৎসাহস হারিয়ে ফেলায় এখন মাত্র আটটি খেজুরগাছ থেকে রস আহরিত হয়। প্রতি সপ্তায় এসব গাছ থেকে তারা খাওয়ার জন্য মাত্র এক ভাড় রস পেয়ে থাকেন। বাকি এক ভাড় বা তার একটু বেশি রস নিয়ে বিক্রি করেন গাছি। সেভাবে আর গুড় উৎপাদন হয় না।
তারপরও বাজারে খেজুরের গুড় নামে যা বিক্রি হয় তা মূলত সামান্য রসের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে তৈরি হয় বলে জানান আলী রেজা। এই প্রক্রিয়া ক্রেতাকে ধোঁকা দেওয়া ছাড়া কিছুই না।
যশোর শহরের বড়বাজারের গুড় ব্যবসায়ী রফিক বলেন, গুড় তৈরি হচ্ছে কৃত্রিম চিনি ও রাসায়নিক রঙ দিয়ে। এসব গুড়ে স্বাদ ও গন্ধ কিছুই থাকে না। অতিমাত্রায় বাণিজ্যিক চিন্তা এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের অতি লোভ খেজুরের ভেজাল গুড় তৈরির কারণ। বাড়তি চাহিদা সামাল দিতে এবং রঙ উজ্জ্বল করতে খেজুর গুড়ে চিনি, ফিটকিরি ও অন্যান্য রাসায়নিক মেশানোর অভিযোগও রয়েছে।
বাঘারপাড়া উপজেলার সুড়ো গ্রামের গাছি সালাম হোসেন জানান, চিনির দাম তুলনামূলক কম। এ কারণে সামান্য রসের মধ্যে চিনি মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে গুড় বানানো হচ্ছে। এসব গুড় হরহামেশা বিক্রি হচ্ছে।
অনলাইনে ভেজাল গুড় ও পাটালি
যশোরের গুড় ও পাটালির জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে ভেজাল গুড়ের জোরদার কারবার শুরু হয়েছে অনলাইনে। এসব প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গুড় ও পাটালি সংগ্রহ করে তা যশোরের বলে বিকোচ্ছেন। যেগুলোর মান সন্তোষজনক না হওয়ায় যশোরের খেজুরের গুড় সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা পৌঁছাচ্ছে সাধারণের কাছে। তবে সব বিক্রেতা জালিয়াতির আশ্রয় নেন না বলে উদ্যোক্তাদের দাবি।
অনলাইনে গুড় ও পাটালি বিক্রির প্রতিষ্ঠান ইভেন্টটেকের সহ-প্রতিষ্ঠাতা নাহিদুল ইসলাম জানান, ২০১৮ সালের ১৭ নভেম্বর থেকে ‘কেনার হাট’ নাম দিয়ে অনলাইন ব্যবসা পরিচালনা করছেন তিনি। ভেজালমুক্ত গুড় ও পাটালি সরবরাহের জন্য তিনি শুরু থেকে গাছিদের ন্যায্যমূল্য দেওয়ার চেষ্টা করছেন। গাছিদের খাঁটি গুড় ও পাটালি তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং সচেতনতা সৃষ্টি করেছেন বলে দাবি তার। যারা যশোরের খাঁটি গুড় বিক্রি করে তাদের মধ্যে নিজের প্রতিষ্ঠান আছে উল্লেখ করে নাহিদ বলেন, তারা জেলার বাঘারপাড়া, মণিরামপুর, কেশবপুরে ৭০-৮০ জন গাছিকে চুক্তিবদ্ধ করেছেন। প্রতি বছর কয়েকজন বদলও হয়।
‘গাছিদের যদি ন্যায্যমূল্য দেওয়া হয়, তাহলে তারা গুড়ে ভেজাল দেবেন না, এমনটা গাছিদের প্রতি বিশ্বাস করা যায়,’ বলেছেন নাহিদুল ইসলাম।
নাহিদের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ কয়েকজন গাছির সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। এরকম একজন গাছি বাঘারপাড়ার ছাতিয়ানতলার সোবহান। ‘গাছিদের গুড় ও পাটালির ন্যায্য মূল্য দিলে কেউ ভেজাল দেবে না’ নিশ্চয়তা দিয়ে তিনি বলেন, রস জ¦াল দিয়ে গুড় পর্যায়ে যাওয়ার আগেই চিনি ঢেলে দেয় ভেজালকারীরা। আবার অনেকে ঠিলের মধ্যে চিনি দিয়ে গাছে ঝুলিয়ে রাখে। আস্তে আস্তে রস পড়ে এবং চিনি ওই রসের সাথে মেশে। এরপর রস জ্বাল দিয়ে কেউ কেউ গুড় বা পাটালি তৈরি করছেন।
গুড় ও পাটালি বিক্রির অন্যতম উদ্যোক্তা প্রিয়াংকা রানী সুর। তিনি ২০১৯ সাল থেকে অন্যান্য ব্যবসার সঙ্গে ‘দেশি ফেরিওয়ালা’ নাম দিয়ে গুড় ও পাটালির ব্যবসা করছেন। ‘গাছিদের শ্রমের ন্যায্য মূল্য দিলে তারা ভেজাল করেন না। তবে বেশি পরিমাণ গুড় ও পাটালির চাহিদা দেখা যায়। তখনই কেউ কেউ গুড়ের মধ্যে চিনি মেশানোর চেষ্টা করেন’ জানিয়ে তিনি বলেন, তবে, তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ১৩-১৪ জন গাছি এরকম করেন না।
‘যশোরে কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ভেজাল গুড় ও পাটালির ব্যবসা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের ব্যবসায় কোনো ব্রান্ডিং নেই। গুড় ও পাটালির ব্যবসা শেষ হলে তারাও নিখোঁজ হন। ফলে তারা ভেজাল গুড় বিক্রি করেই চলে যাচ্ছেন। তখন প্রতিষ্ঠিত উদ্যোক্তাদের ঝামেলায় পড়তে হয়,’ যোগ করেন প্রিয়াংকা রানী সুর।
‘প্রাপক’ নাম দিয়ে যশোরে তিন বছর ধরে গুড় ও পাটালির ব্যবসা করছেন এম এ রাজা। তিনি জানান, চৌগাছায় আট থেকে দশজন গাছির সাথে খাঁটি গুড় ও পাটালি দেওয়ার চুক্তি রয়েছে তার। চুক্তি মোতাবেক তারা কখনো ভেজাল দেবেন না। প্রথম পর্যায়ে গুড় ও পাটালির ভেজাল বোঝা যায় না। কয়েকমাস পর রেখে দেওয়া গুড় ও পাটালিতে হালকা সাদা সাদা দেখা যায়। তিনি গাছিদের খাঁটি গুড় ও পাটালি বিক্রির পরামর্শ দিয়েছেন।
যশোরের ব্যবসায়ীরা শুধু অনলাইনে গুড় ও পাটালির ব্যবসা করেন না। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা যশোরের গাছিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তারাও গুড় ও পাটালির ব্যবসা করছেন।
বড়বাজারের ব্যবসায়ী সুমন বলছেন, ঢাকার কয়েকজন ব্যবসায়ী তার কাছ থেকে গুড় ও পাটালি কিনে সারা দেশে অনলাইনে ব্যবসা করছেন।
ভেজাল গুড় খেলে হতে পারে যেসব রোগ
কেশবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাক্তার রেহনেওয়াজ বলেন, রসের সাথে বিভিন্ন কেমিকেল, রাসায়নিক রঙ ব্যবহার করে তৈরি গুড় স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। এসব গুড় খাওয়ার পর পেটের পীড়া, কিডনি, লিভারসহ বিভিন্ন রোগ হতে পারে। এমনকি ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও থাকে বলে জানিয়েছেন তিনি। সে কারণে ভেজাল গুড় না খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ডাক্তার রেহনেওয়াজ।
আসল খেজুর গুড়ের স্বাস্থ্য উপকারিতা
যশোর জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক আবুল কালাম জানান, চিনির থেকে গুড় স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো। গুড়ে থাকে লৌহ, ম্যাগনেসিয়াম, জিংক, সেলেনিয়াম এবং পটাশিয়াম। যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় ও জীবাণু সংক্রমণ থেকে দূরে রাখে। তাই শরীর, স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে নিয়মিত গুড় খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন এই চিকিৎসক।
ভেজাল গুড় চেনার উপায়
গুড় কেনার সময় অবশ্যই রঙ দেখে নিতে হবে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখে, স্বাদ নিয়ে বিচার করা যায় গুড়টি ভালো কিনা। যদি শুদ্ধ, ভালো গুড় হয় তাহলে তার রঙ হবে গাঢ় বাদামি। হলুদ রঙ থাকলে বুঝতে হবে যে রাসায়নিক কিছু মেশানো রয়েছে। ভেজাল গুড় বা পাটালি দেখতে চকচকে হয়। গুড়ের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে পাটালি তৈরি করলে সেটা খুব শক্ত হয়। রসালো থাকে না। পাটালির রঙ কিছুটা সাদা হয়ে যায়। গুড়ে হাইড্রোজ, ফিটকিরি ব্যবহার করলেও পাটালির রঙ সাদা হয়। এসব পাটালি ভীষণ শক্ত। আসল খেজুরগুড়ের পাটালি চকচক করে না। খাঁটি পাটালির রঙ হয় কালচে লাল। সেটা নরম ও রসালো হয়। অনেক সময় পাটালির ওপরের অংশ কিছুটা শক্ত হতে পারে, তবে ভেতরে বেশ নরম।
ভেজাল রোধে পদক্ষেপ
গুড়ে ভেজাল না দেওয়ার জন্য গাছিদের নিয়ে বিভিন্ন সভা, সমাবেশ ট্রেনিং করা হয়েছে। তাতেও ভেজাল রোধ করা যায়নি বলে স্বীকার করে যশোরের সিনিয়র বিপণন কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) কিশোর কুমার সাহা বলেন, প্রথমবারের যশোরের চৌগাছা, বাঘারপাড়া, খাজুরাসহ যেখানে খেজুর উৎপাদন হয়, সেখানে ভেজাল রোধে অভিযান চালানো হবে। যশোরে সাতজন নতুন ম্যাজিস্ট্রেট যোগদান করেছেন। ফলে ভেজাল রোধে দ্রুত অভিযান চালানো হবে।
প্রশাসনের পাশাপাশি সকলকে ভেজাল রোধে কাজ করতে হবে। তবেই একদিন ভেজাল গুড় বিক্রি বন্ধ হবে।
খেজুরগাছ
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোর কার্যালয়ের তথ্যমতে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে যশোর জেলায় খেজুরগাছের সংখ্যা ২৩ লাখ ৩০ হাজার ৬৯৫টি। এর মধ্যে রস আহরণের উপযোগী গাছের সংখ্যা তিন লাখ সাত হাজার ১৩০টি। গাছ থেকে তিন কোটি ৭১ লাখ তিন হাজার লিটার রস ও দুই হাজার ৭৪২ মেট্রিক টন গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
তবে, এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে তা বলতে পারেননি সরকারি এই কর্মকর্তা। ফলে, বিষয়টি খাতাকলমে সীমাবদ্ধ থেকে যাওয়ার শঙ্কাই বেশি বলে মনে করেন অনেকে।
মণিরামপুরের আলী রেজা বলেন, দিন যত যাচ্ছে খেজুর গাছ তত কমছে। অসাধু লোকজন খেজুরগাছ কেটে ভাটা মালিকদের কাছে জ্বালানি হিসেবে বিক্রি করে দিচ্ছেন। পেশা পরিবর্তন করার কারণে গ্রামাঞ্চলে বর্তমানে গাছি সঙ্কট। সে কারণে গাছ ‘অযথা’ ফেলে না রেখে অনেকে তা বিক্রি করে দিচ্ছেন বা কেটে ঘরের কাজে ব্যবহার করছেন। এটিও খেজুর গাছ কমে যাওয়ার আর একটি কারণ।
এর থেকে উত্তরণের মাধ্যমে যশোরের খেজুরের রস আর গুড়ের যে সুখ্যাতি রয়েছে তা সমুন্নত রাখতে শুধু লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করে বসে থাকলে হবে না বলে মত দিয়েছেন সবাই। তাদের কথা, ব্যাপকভাবে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি খেজুর গাছের সংখ্যা বৃদ্ধিতে বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। আসল খেজুরের গুড়ের দাম যাতে গাছি ঘরে তুলতে পারেন সেজন্য সঠিক বিপণন ব্যবস্থা এবং গুড় সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণের ওপরও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
গুড়ের মেলা
গাছিদের সচেতন এবং দেশের মধ্যে যশোরের খাঁটি গুড়ের পরিচিতর জন্য যশোরের চৌগাছায় ২০২৩ সাল থেকে গুড়ের মেলার আয়োজন করা হচ্ছে। উপজেলা প্রশাসন থেকে এ মেলার আয়োজন করা হচ্ছে। জানুয়ারি মাসে তিন দিনের এ গুড়ের মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গাছিরা অনেকেই এখানে খাঁটি গুড় ও পাটালি বিক্রি করেন।