জহর দফাদার
, যশোর
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনে অগ্রসেনানী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যশোরের তিন তুখোড় নেতা রাশেদ খান, ইমরান খান আর জেসিনা মুর্শীদ প্রাপ্তি আসছে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন। যশোরের ছয়টি আসনের মধ্যে তিনটিতে লড়বেন এই তরুণ তুর্কিরা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যশোর জেলার সাবেক প্রধান সমন্বয়ক রাশেদ খান যশোর-৩ (সদর) আসনে, অন্যতম সমন্বয়ক ইমরান খান যশোর-২ (ঝিকরগাছা-চৌগাছা) আসনে এবং সাবেক সদস্যসচিব জেসিনা মুর্শীদ প্রাপ্তি যশোর-৬ (কেশবপুর) আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে জানিয়েছেন।
অগ্নিঝরা ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে যশোরের রাজপথে শত-সহস্র নারী-পুরুষ-শিশুর যে জোয়ার নামে—সেই আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দেন—সামনের কাতারের সংগঠকদের মধ্যে উল্লিখিত তিনজনের নাম রয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই তরুণ নেতৃত্ব পৃথক তিনটি রাজনৈতিক দলের ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের যশোর জেলা সংসদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সম্মেলনে রাশেদ খান জেলা সংসদের সভাপতি নির্বাচিত হন। যশোর-৩ (সদর) আসনে তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) প্রার্থী হিসেবে কাস্তে মার্কা নিয়ে নির্বাচন করবেন।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (যবিপ্রবি) থেকে রসায়ন শাস্ত্রে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করা রাশেদ খান একজন ভালো আঁকিয়েও। উত্তাল সময়ে তার নিজের আঁকা ও লেখা প্লাকার্ড, পোস্টার, ব্যানার, গ্রাফিতি শহরের বিভিন্ন প্রান্তে শোভা পায়। রাশেদ খান শোষণ-বঞ্চনা, নিপীড়নের বিরুদ্ধে যেকোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সামনের সারির যোদ্ধা।
তিনি বলেন, ‘পার্টি থেকে মনোনীত হয়েছি। আগামী ২৫ ডিসেম্বরের আগেই জেলা রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করা হবে।’
ইতোমধ্যে তিনি গণসংযোগে তার নির্বাচনি লড়াইয়ের বিষয়ে জানান দিয়েছেন। মনোনয়নপত্র সংগ্রহের পর দল ও জোটগতভাবে প্রচারণায় যাওয়ার আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করেন তিনি।
এই আসনে বড় দল বিএনপির প্রার্থী দলের খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত ও জামায়াতে ইসলামীর আব্দুল কাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
যশোর-২ (ঝিকরগাছা-চৌগাছা) আসনে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) মই মার্কা নিয়ে নির্বাচনি যুদ্ধে অংশ নিচ্ছেন স্বৈরাচার পতন আন্দোলনের আরেক যোদ্ধা ইমরান খান। ইতোপূর্বে একবার এই আসনে একই দলের নেতা হাচিনুর রহমান নির্বাচন করেছিলেন।
যশোর সরকারি এমএম কলেজ থেকে বিএসসি ও এমএসসি করা ইমরান খান শহীদ মসিয়ূর রহমান আইন মহাবিদ্যালয় থেকে এলএলবি সম্পন্ন করেছেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট এমএম কলেজ শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বাসদের খানিকটা সাংগঠনিক ভিত্তি রয়েছে চৌগাছায়। ঝিকরগাছা উপজেলায় এখনো কোনো কমিটি গঠন করা হয়নি।
তিনি বলেন, ‘আমি চৌগাছার সন্তান। গরিব-শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গেই উঠাবসা। সার, কীটনাশক, বীজ নিয়ে কৃষকদের আন্দোলন সংগ্রামের সঙ্গেই থেকেছি ছাত্ররাজনীতি করাকালে। এখনো আছি তাদের সঙ্গেই। মানুষের সঙ্গে নির্বাচনি কথাবার্তা বলছি।’
এই আসনে বড় দুটি দল যথাক্রমে বিএনপির প্রার্থী দলের কেন্দ্রীয় সদস্য ও উপজেলা কমিটির সভাপতি সাবিরা সুলতানা মুন্নী এবং জামায়াতের ডা. মোসলেহ উদ্দীন ফরিদ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে যশোরে অনেক নারী শিক্ষার্থীই রাজপথে ছিলেন। তাদের মধ্যে জেসিনা ছিলেন সামনের কাতারে। জেসিনা মুর্শীদ প্রাপ্তি যশোর সরকারি মহিলা কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক। বর্তমানে তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি করছেন।
প্রাপ্তি গণঅধিকার পরিষদ থেকে প্রার্থী মনোনীত হয়েছেন। তিনি লড়বেন ট্রাক প্রতীক নিয়ে।
তিনি বলেন, ‘স্বৈরাচার পতনের পর যশোরে যে বন্যা পরিস্থিতি ছিল, সেইসময় আমি কেশবপুর-মণিরামপুর অঞ্চলে গিয়েছি। জলাবদ্ধ মানুষের দুঃখ-দুর্দশার মূল কারণ উদ্ঘাটন এবং করণীয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে অল্প-স্বল্প কাজ করেছি। এছাড়া কেশবপুরে আমাদের আত্মীয়-স্বজনও আছে। গতানুগতিক ধারার বিপরীতে আমাদের রাজনীতি—এই বিষয়টিকে মূল্যায়ন করছি। মানুষের কাছে যাচ্ছি, অনেকেই উৎসাহ দিচ্ছেন।’
এই আসনে বিএনপির প্রার্থী দলের কেন্দ্রীয় সদস্য কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ ও জামায়াতের অধ্যাপক মুক্তার আলী। যদিও বিএনপির প্রার্থী বদল হতে পারে বলে জোর গুঞ্জন রয়েছে।
প্রচলিত নির্বাচনি ব্যবস্থার বিপরীতে দাঁড়িয়ে এই তরুণ তুর্কিরা যেন সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করার লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন—সেই লক্ষ্যে তাদের জন্যে শুভকামনা এবং নির্বাচনি লড়াইয়ে পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছেন বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ যশোর জেলা কমিটির সম্পাদক তসলিম-উর-রহমান।
তিনি বলেন, ‘আমরা রাজনৈতিকভাবেই তরুণ-নবীন নেতৃত্বকে স্বাগত জানাই। যশোরের তিনটি আসনে যে তিনজনের নাম শোনা যাচ্ছে, তারা ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন থেকেই যশোরের পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন। এই তিনজনের দুইজন রাশেদ খান ও ইমরান খান আমাদের জোটভুক্ত যুক্তফ্রন্টের শরিক দুই দলের। সেই কারণে তাদের দুইজনের জন্যে আমাদের কাজ করতেই হবে। অপরজন জোটভুক্ত না হলেও তার জন্যে শুভ কামনা থাকবে।’
জানতে চাইলে জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মুনীর আহমেদ সিদ্দিকী বাচ্চু বলেন, তরুণরা যে এগিয়ে আসছে—এটি অত্যন্ত সুখের বিষয়। আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে তরুণদেরই এগিয়ে আসতে হবে। তাদের জন্যে শুভ কামনা থাকলো।
জেলা জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি অধ্যাপক গোলাম কুদ্দুস বলেন, ‘স্বাধীন দেশে সুযোগ আছে, যে কেউ প্রার্থী হতে পারেন। আমাদের দলীয় প্রার্থী রয়েছেন, আমরা চেষ্টা করবো তাদের বিজয়ী করতে।’
তিনি বলেন, ‘যাদের (তরুণ প্রার্থী) কথা বলছেন—সেইসময়ে তাদের জন্যে মানুষের মধ্যে আবেগ ছিল, তা তাদের কাজে আসতেও পারে।’