জহর দফাদার
, যশোর
দলীয় মনোনয়ন নিয়ে যশোরের ছয়টি আসনের মধ্যে পাঁচটিতেই লেজেগোবরে অবস্থা তৈরি হয়েছে বিএনপিতে। ঘোষিত প্রার্থী আর মনোনয়নপ্রত্যাশীদের রশিটানাটানিতে দলের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা চরমে পৌঁছেছে। ব্যতিক্রম শুধু যশোর-৩ (সদর) আসনে।
দীর্ঘদিন সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়া, ক্ষমতায় জেঁকে বসা আওয়ামী লীগ বিতাড়িত হওয়ায় বিএনপি নেতাদের অনেকেই ভাবছেন, এবার সহজেই তাদের দল ক্ষমতায় যাবে। ফলে রাজপথের লড়াইয়ে থাকা নেতাদের বড় অংশের মনে সংসদে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি। কিন্তু আসনপ্রতি একজনকে চূড়ান্ত মনোনয়ন দেওয়া যাবে¬, আবার ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোকেও সন্তুষ্ট করতে হবে- এই অমোঘ সত্য অনেকের কপাল পুড়িয়েছে। প্রার্থী হতে ইচ্ছুক নেতাদের নিজ নিজ বলয় আছে। এক বলয়ের নেতাকর্মীরা অন্য বলয়ের প্রার্থীকে মেনে নিতে নারাজ। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতাও যাতে দলীয় টিকিট না পান, তেমন তৎপরতা চালানোর অভিযোগও আছে প্রভাবশালী অন্য নেতাদের বিরুদ্ধে।
যশোরের শুধু একটি আসনেই মনোনয়ন নিয়ে কোনো বিরোধ নেই। সেটি হলো যশোর-৩ (সদর) আসন। এই আসনে দলের প্রার্থী বিএনপির কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক (খুলনা বিভাগ) অনিন্দ্য ইসলাম অমিত।
যশোর-১ (শার্শা)
যশোর-১ (শার্শা) আসনে মোটাদাগে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন তিনজন। এরা হলেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক দপ্তর সম্পাদক মফিকুল হাসান তৃপ্তি, শার্শা উপজেলা সভাপতি হাসান জহির এবং সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান লিটন।
এই আসনে প্রথমে মনোনয়নপত্র দেওয়া হয় মফিকুল হাসান তৃপ্তিকে। মনোনয়ন পেয়েই তিনি অনুসারীদের নিয়ে গণসংযোগে নেমে পড়েন। নির্বাচনি এলাকায় ব্যাপক প্রচার-প্রচারণাও চালান। কিন্তু সেইসময়ে তার সঙ্গে ছিলেন না মনোনয়নপ্রত্যাশী অপর দুই নেতা ও তাদের অনুসারীদের কেউ। এমনকী তারা তৃপ্তির মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে কাফনের কাপড় পরে যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক অবরোধের মতো কর্মসূচিও পালন করেন। যার প্রেক্ষিতে হাসান জহির ও নুরুজ্জামান লিটনকে দলীয় কার্যালয়ে হাজির হয়ে কারণ দর্শানোর নির্দেশও দেওয়া হয়।
কিন্তু নানা কারণে মফিকুল হাসান তৃপ্তিকে বদলে ওই আসনে দলীয় প্রার্থী হিসেবে নুরুজ্জামান লিটনের হাতে গেল ২৪ ডিসেম্বর রাতে মনোনয়নপত্র তুলে দেওয়া হয়। এর কয়েকদিন আগে থেকেই নির্বাচনি এলাকায় জোর গুঞ্জন ছিল যে, এই আসনে বিএনপির প্রার্থী পরিবর্তন করা হতে পারে। এই সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন গত ২৪ ডিসেম্বর সুবর্ণভূমিতে প্রকাশিত হয়। ঢাকায় গিয়ে দলের নীতিনির্ধারকসহ ঊর্ধ্বতন মহলে জোর চেষ্টা-তদবির করেও তৃপ্তি সফল হতে পারেননি। অবশ্য এখনও যে তিনি হাল ছেড়ে দিয়েছেন- তেমনটিও না।
এদিকে, এক মাসের বেশি সময় ধরে মাঠে প্রচারণায় থাকা তৃপ্তির অনুসারীরা প্রার্থী পরিবর্তনে চরম হতাশ হন। উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন লিটনের অনুসারীরা। ইতিমধ্যে তারা মাঠে নেমে পড়েছেন। আগের মতোই এক পক্ষ অদৃশ্য হয়ে গেছে নির্বাচনি মাঠ থেকে। যদিও তাদের কেউ কেউ ভাবছেন, এখনও সময় শেষ হয়ে যায়নি, ঘটতে পারে যেকোনো কিছু। অন্যদিকে, হাসান জহিরের অনুসারীরা কী করবেন, তা এখনও নিশ্চিত না।
এ বিষয়ে মফিকুল হাসান তৃপ্তি বলেন, ‘নেতাকর্মী-সমর্থকদের বলেছি শান্ত থাকতে। ঢাকা থেকে ফিরে সবার সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তিনি মনোনয়নপত্র জমা দেবেন বলেও জানান।
আর নুরুজ্জামান লিটনের ভাষ্য, ‘আমি আগেও বলেছি দলীয় সিদ্ধান্তের পক্ষে থাকবো, এখনও বলছি একই কথা। আমি সবসময় ধানের শীষের পক্ষে।’
যশোর-১ আসনে বিএনপির প্রধান প্রতিপক্ষ জামায়াতের প্রার্থী মাওলানা আজীজুর রহমান। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জোটের প্রার্থী হিসেবে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী শেখ আফিল উদ্দিনের কাছে অল্প ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিলেন।
যশোর-২ (ঝিকরগাছা-চৌগাছা)
এই আসনেও খুবএকটা স্বস্তিতে নেই বিএনপি প্রার্থী সাবিরা সুলতানা মুন্নী। এই আসনে মনোনয়ন চেয়েছিলেন অনেকেই। তাদের মধ্যে এখনো শুভদিন খুঁজছেন যশোর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মিজানুর রহমান খান, চৌগাছা উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি জহুরুল ইসলাম, ঝিকরগাছা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইমরান সামাদ নিপুণ। মিজানুর রহমান খান ও জহুরুল ইসলামের সমর্থকরা এখনো বিশ্বাস করেন, দল তাদের প্রতি ‘সুবিচার’ করবে। আর এককভাবে দলের একাংশের নেতাকর্মী আর সমর্থকদের নিয়ে গণসংযোগে রয়েছেন সাবিরা মুন্নী। মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতাদের কোনো অনুসারীকে মোটাদাগে তিনি এখনও নিজের পক্ষে আনতে পারেননি।
এই আসনে বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতের ডা. মোসলেহউদ্দিন ফরিদ। লন্ডন থেকে উড়ে আসা এই প্রার্থীকে এলাকার কেউ চিনতেন না। কিন্তু একাট্টা জামায়াত তার পক্ষে মাঠে-ময়দানে কাজ করে চলেছে। প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির ছন্নছাড়া অবস্থা তাকে বেশ সুবিধা দিচ্ছে।
যশোর-৪ (বাঘারপাড়া, অভয়নগর উপজেলা ও সদরের বসুন্দিয়া ইউনিয়ন)
এই আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও কৃষকদলের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার টি এস আইয়ুব। ব্যবসা-বাণিজ্যে নিযুক্ত আইয়ুবের ব্যাংক সংক্রান্ত কিছু ঝামেলা আছে। সেই কারণে তার মনোনয়ন নির্বাচন কমিশন বাতিল করতে পারে আশঙ্কায় দল ‘বিকল্প প্রার্থীও’ রেখেছে। এই আসনের ‘বিকল্প প্রার্থী’ অভয়নগর উপজেলা বিএনপির সভাপতি মতিয়ার রহমান ফারাজীকে শুক্রবার মনোনয়ন ফরম দিয়েছে দলটি। এরপর ওই রাত থেকেই নির্বাচনি এলাকাটিতে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম বিভ্রান্তি-অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। কর্মীরা নিশ্চিত হতে পারছেন না, চূড়ান্ত টিকিট কার কপালে জুটবে।
টিএস আইয়ুব যশোর-৪ আসনে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা- এতে কারও কোনো সন্দেহ নেই। বিএনপির সবস্তরের নেতাকর্মী মনে করেন, টিএস আইয়ুবের প্রার্থিতা টিকলে তার জয়ের সম্ভাবনা অনেক বেশি। তা সত্ত্বেও দলীয় প্রতিপক্ষ তার বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে। গতকাল শনিবারও বাঘারপাড়ার একজন প্রভাবশালী নেতা যশোরের রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে এসে নানা কাগজপত্র দিয়ে যান, যাতে টিএস আইয়ুবের মনোনয়ন বাতিল হয়।
এই প্রসঙ্গে টিএস আইয়ুব সুবর্ণভূমিকে বলেন, ‘আমিই বিএনপির চূড়ান্ত প্রার্থী- এতে কোনো সন্দেহ নেই। ব্যাংক সংক্রান্ত জটিলতা কেটে গেছে। দল ও নির্বাচন কমিশনের কাছে আপডেট কাগজপত্র পৌঁছে যাবে। যে যত ষড়যন্ত্রই করুক না কেন, কোনো কাজ হবে না।’
যশোর-৫ (মণিরামপুর)
এই আসনে বিএনপি প্রথম দফায় কাউকে মনোনয়ন দেয়নি। তখন বাজারে প্রচার ছিল, আসনটি যুগপৎ আন্দোলনে শরিক জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। পরে মণিরামপুর উপজেলা বিএনপি সভাপতি শহীদ মোহাম্মদ ইকবাল হোসেনকে মনোনয়নপত্র দেওয়া হয়। এরপর আসনটিতে জোরেসোরে নির্বাচনি কার্যক্রম শুরু করেন ইকবাল ও তার অনুসারীরা। কিন্তু অল্পদিনের ব্যবধানে এই চিত্র বদলে যায় জমিয়ত নেতা মুফতি রশীদ বিন ওয়াক্কাসকে ধানের শীষের প্রার্থী ঘোষণায়।
আসনটি ছেড়ে দেওয়ার প্রতিবাদে দুইদিন ধরে বিক্ষোভ করছেন নেতাকর্মীরা। তারা মিছিল, রাস্তায় শুয়ে পড়ার মতো কর্মসূচিও পালন করছেন। ‘অবৈধ মনোনয়ন মানবেন না’ বলেও স্লোগান দিচ্ছেন।
বিএনপি নেতাকর্মীরা মনে করছেন, অ্যাডভোকেট ইকবালের মনোনয়ন বহাল রাখা হলে তিনি নিশ্চিত বিজয় অর্জন করতেন। আসনটি জমিয়তকে ছেড়ে দেওয়ায় তারা হতাশ ও ক্ষুব্ধ। ইকবালকে মনোনয়ন না দেওয়া হলে আন্দোলনের আরও কর্মসূচি দেওয়া হবে বলে তারা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন।
স্থানীয় এক বিএনপিনেতা জানান, মণিরামপুরে ৮৪ হাজার ধর্মীয় সংখ্যালঘু ভোট আছে। সেই ভোট টানার সক্ষমতা আছে শুধু শহীদ ইকবালের। জমিয়তের প্রার্থীর পক্ষে এই ভোট আনা কঠিন হবে।
শহীদ মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন বলেন, ‘দলের নেতাকর্মীরা এই বিষয়টি (জমিয়তকে আসন ছেড়ে দেওয়া) মেনে নিতে পারছেন না। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। প্রার্থিতা পুনর্বিবেচনার জন্য কেন্দ্রীয় বিএনপির কাছে আবেদন জানিয়েছি। ঢাকায় রয়েছি। ২৯ ডিসেম্বরের আগেই এলাকায় ফিরে দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বসে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবো।’
যশোর-৬ (কেশবপুর)
গত ২৪ ডিসেম্বর রাতে এই আসনে বিএনপির মনোনয়নপত্র তুলে দেওয়া হয় কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও কেশবপুর উপজেলা সভাপতি আবুল হোসেন আজাদের হাতে। এর আগে প্রথম দফায় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণকে।
প্রাথমিক মনোনয়ন পেয়ে তরুণ নেতা কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ অনুসারীদের নিয়ে মাসাধিককাল এলাকায় ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন। যদিও আবুল হোসেন আজাদের অনুসারী হিসেবে পরিচিত কেউ মোটা দাগে শ্রাবণের সঙ্গে মাঠে নামেননি। কিন্তু গেল সপ্তাহে নির্বাচনি এলাকায় রটে যায় যে, মনোনয়ন পরিবর্তন হচ্ছে। এর পরপরই মাঠ থেকে উঠে যান শ্রাবণের অনুসারীরা। উল্টোদিকে চাঙা হয়ে ওঠেন আবুল হোসেন আজাদের অনুসারীরা।
স্থানীয় ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মনোনয়ন পরিবর্তনে নেতাকর্মীর মধ্যে যেমন উচ্ছ্বাস রয়েছে, তেমনি দলীয় অনেক সমর্থক ও সাধারণ ভোটারের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়াও আছে।
দীর্ঘ ২৫ বছর কেশবপুরে বিএনপির হাল ধরে রেখেছিলেন আবুল হোসেন আজাদ। তাকে চূড়ান্ত মনোনয়ন দেওয়ায় বিএনপির বেশিরভাগ নেতাকর্মী ঐক্যবদ্ধ থাকবেন। অপরদিকে, প্রাথমিক মনোনয়ন পাওয়া কাজী রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণকে বাদ দেওয়ায় দলের তরুণ-যুব ভোটারদের মধ্যে মধ্যে হতাশা কাজ করছে। এতে করে জামায়াতের লাভ বেশি হচ্ছে।
দলের কেশবপুর কমিটির সাধারণ সম্পাদক সহকারী অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আবুল হোসেন আজাদ মনোনয়ন পাওয়ায় দীর্ঘদিনের হারানো আসনটি পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে।
কাজী রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণ অবশ্য বলেছেন, ২৯ ডিসেম্বরের পরে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবেন।
যশোর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন খোকন বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে দলের জন্যে যারা কাজ করছেন, তারা মনোনয়ন না পেলে মন খারাপ হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু দলীয় সিদ্ধান্ত আমাদের সবাইকে মানতে হবে। নমিনেশন সাবমিটের পরে সবাইকে নিয়ে আমরা বসবো। আশা করছি, ঐক্যবদ্ধভাবে ধানের শীষকে বিজয়ী করতে সবাই কাজ করতে পারবো।’
তবে দলীয় নেতাকর্মীরা বলছেন, যে লেজেগোবরে অবস্থা তৈরি হয়েছে, তা মেটানো কঠিন হবে। একমাত্র তারেক রহমানের হস্তক্ষেপ ছাড়া পরিস্থিতি উত্তরণের সম্ভাবনা কম।