কটন ট্রির নাম প্রথম শুনেছিলাম ডেভিড কামারার মুখে। আমরা সিয়েরালিওনে যাওয়ার আগে থেকেই সে ছিল আমাদের গডরিচ ক্যাম্পের ‘হরফুন মাওলা’। ঘরের চাল ছাইতে হবে তো ডাকো কামারাকে, ক্যাম্পে দেয়াল তুলতে হবে, কামারা জানে কোথায় পাওয়া যাবে বিল্ডিং ব্লক। মেসে বিশেষ কোনো খাবার রান্না হবে, ডেভিড জানে মাল মসলা কোথায় সুলভ। আমার এসব কিছুর দরকার ছিল না। আমি অবাক হলাম এক শুক্রবারে তাকে মসজিদে দেখে। বিস্ময়ে আমার চোয়াল ঝুলে যেতে দেখে সে বলল, ‘স্যার আই অলসো য়্যাম দ্য মুয়াজ্জিন হিয়া’। আমি কিছু বলার আগেই সে বলল, “ডেভিড’স মাই ক্রিশ্চিয়ান নেইম অনলি।”
আমার ঘোর কাটলো সব কথা শোনার পর। এখানে ভালো স্কুলে পড়ার জন্যে ‘ক্রিশ্চিয়ান নাম’ রাখতে হয়। ক্রিশ্চিয়ান মিশনারিরা চালায় সেসব স্কুল। মুসলিমদের চান্স পাওয়া কঠিন। ডেভিডের আসল নাম দাউদ আলি কামারা। ‘খ্রিস্টান নাম’ থাকলে স্কুল আর এনজিওতে ঢোকা সোজা। তার স্কুলের কাজটি হয়েছিল ঠিকই, তারপর যুদ্ধ লেগে গেল। ভয়ে এনজিও আসা কমিয়ে দিলো। খ্রিস্টান নামটি অকেজো পড়ে রইল, ডেভিডের দিন কাটতে লাগল ব্যানসিগের (বাংলাদেশ সিগন্যালস) ফাই-ফরমাশ খেটে।
আমি ব্যানসিগের লিয়াজোঁ অফিসার। কারণে-অকারণে আমাকে সিয়েরা লিওনের ইমিগ্রেশন, নানান দেশের এম্বাসি, আর সরকারি অফিসে ঘুরে বেড়াতে হয়। এক বিকেলে ডেভিড উঠে বসলো জিপের পেছনে। আমি যদি তাকে কটন ট্রি অব্দি পৌঁছে দিই সে এভার গ্রেটফুল থাকবে। আমাদের যশোরে একটি তুলোতলা আছে, সেখানে ইন্ডিয়ান পণ্যের চোরাই মার্কেট বসতো এক সময়। বন্ধু, স্বজনের হাজার অনুরোধেও আমি সেখানে যাইনি। আজ এত দূরে এসে আবার তুলোতলার চক্কর! আমি বললাম, ‘কোথায় তোমার সেই তুলোতলা?’
কামারা বাংলা বোঝে। সে বলল, “নো তুলোতলা স্যার। ইট’স কটন ট্রি।” বললাম, ‘আমার ন্যশনাল ব্যাংকে কাজ আছে।’
সে বলল, ‘নো প্রব্লেম। সুপ্রিম কোর্ট বিল্ডিং, ন্যাশনাল মিউজিয়াম, ন্যাশনাল ব্যাংক সব ওখানেই।’
অনেক দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম গাছটি। কামারাকে সিয়াকা স্টিভেন্স রোডের মোড়ে নামিয়ে দিতে গিয়ে বৃক্ষের বিশালতা দেখে গাড়িতে বসে থাকতে পারলাম না। গাছের চারিদিকে বাঁধাই করে বেদির মতো করে দেওয়া হয়েছে। বেদির ওপর বিভিন্ন সময় মেলা বসে। উৎসব হয়। এই বৃক্ষের কাণ্ডের ব্যাস এখন ৩৬ ফুট ছাড়িয়ে গেছে। প্রায় ২৪ জন লাগে এই গাছটিকে বেড় দিয়ে ধরতে। শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত হয়েছে পৌনে পাঁচশ’ ফুটের মতো। দাউদ কামারা গাড়ি থেকে নেমে গাছের তলায় হাঁটতে থাকলো।
একটিমাত্র গাছ কীভাবে একটি শহরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে যায় সেটা শুনলাম কামারার মুখে।
সে বলল, ‘দিস ইস স্যার, দ্যা সেন্টার পয়েন্ট অব ফ্রি টাউন।’
মনে হলো বেশ তো রাজধানীর ঠিক মাঝখানে চারিদিকে শাখা-প্রশাখা মেলে দিয়ে রাজার মতো দাঁড়িয়ে আছে বাবা শিমুলগাছ।
কামারা বলল, ‘ইউ নো হাউ ওল্ড দিস ট্রি ইজ! ফ্রিটাউনের মানুষরা বলে এই গাছের বয়স পাঁচশো বছর। (একটি শিমুলগাছ এত দিন বাঁচে কি-না জানি না, গাছের প্রতি আমার ভালোবাসা আছে, বিশেষজ্ঞ নই)।’
আড়াইশ’ বছর আগে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যে সব ক্রীতদাস ব্রিটিশদের পরাজিত করে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ফ্রিটাউনের পত্তন করেছিলেন অথবা ১৭৯২ সালের ১১ মার্চ যে সব ক্রীতদাসকে আটলান্টিকের এপারে এনে ব্রিটিশ রাজ মুক্ত করে দিয়েছিল, সমুদ্র থেকে মুখ তুলেই তারা দেখতে পেয়েছিল এই গাছটিকে। সে যেন সমুদ্রের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিল, তাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্যেই।
সেই সদ্য মুক্ত মানুষেরা বিশাল এই গাছটিকে ঘিরে শুরু করেছিল মুক্তির উৎসব। এই গাছের ঋজুতা তাদের মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখালো। অন্ত্যজ ক্রীতদাসদের গ্র্যনভেল বস্তি ধীরে ধীরে বদলে গেল ফ্রি টাউন শহরে।
সেই থেকে এই শিমুলগাছটি এই শহরের অভিভাবকের মতো। শোকে-অসুখে, উৎসবে-পার্বণে সবাই ছুটে আসে শহরের কেন্দ্রস্থলে কটন ট্রির কাছে। আমার সেদিনের কাজ মাথায় উঠলো।
সন্ধ্যা নেমে আসছিল। ডেভিডকে দেখে মনে হলো, সে মুনাজাতের ভঙ্গিতে কথা বলছে গাছের সাথে। আমার সাথে চোখাচোখি হতেই লজ্জা পেয়ে গেল। বললাম, ‘তুমি কী গাছের সাথে কথা বলছিলে?’
সে কিছু বললো না। ফেরার পথে বললো, ‘ইউ নো কটন ট্রি ক্যান হিয়া পিপল।’
বললাম, বেশ, তুমি কী বলছিলে? সে বলল, ‘আই ওয়াজ প্রেইং। দেয়ার আর সো মেনি থিংস টু প্রে।’
পুনশ্চ: ডেভিড কামারার নামটি ডেভিড নাও হতে পারে, মনে করার চেষ্টা করছি।
লেখক: সাবেক সেনা কর্মকর্তা, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক। বর্তমানে উত্তর আমেরিকা প্রবাসী।