এস এম সাইদুল ইসলাম
রেড রিভারের দিকে তাকালে আমার ছোটবেলার ভৈরবের কথা মনে পড়ে যায়। আমার শৈশবে দেখা প্রথম নদী ভৈরব। পশ্চিমবাংলার করিমপুরে জলাঙ্গী নদী থেকে জন্ম নিয়ে অনেক ঘুরপথে মেহেরপুর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ভৈরব।
আর আমারিকার লেক ট্রাভার্স থেকে জন্ম নিয়ে নর্থ ডাকোটা ও মিনেসোটা অঙ্গরাজ্য ঘুরে পেম্বিনা সীমান্ত দিয়ে কানাডা ঢুকে লেক উইনিপেগে বিলীন হয়েছে রেড রিভার। ভৈরব যেমন যশোর শহরকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে খুলনার দিকে বয়ে গেছে, রেড রিভারও সেভাবেই উইনিপেগকে পূর্ব-পশ্চিমে দু’ভাগ করে করে লেক উইনিপেগের দিকে গড়িয়েছে।
রেড রিভারের বয়স নাকি সাড়ে নয় হাজার বছর। উইনিপেগের জন্ম হয়েছে তার চোখের সামনে। ফোর্কের কাছে এসিনিবিওন নদী যেখানে রেড রিভারের সাথে মিলিত হয়েছে, প্রায় তিনশ’ বছর আগে এখানে নির্মিত হয়েছিল ফোর্ট রুজ। মেটিস আদিবাসী, পথক্লান্ত পরিব্রাজক আর ফার্স্ট নেশনের মানুষরা তখন থেকেই এখানে বসত গড়া শুরু করে। ফার ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যতরী আর উত্তর আমেরিকায় ঘর বাঁধতে আসা ব্রিটিশ সেটেলারদের পালের নৌকার যাওয়া-আসা শুরু হয় এই পথে।
৮৭৭ কিলোমিটার দীর্ঘ রেড রিভারের একটি পাড়ে দাঁড়িয়ে সুর্য ডোবা দেখতে দেখতে আমার শৈশবের নদীর কথা আবার মনে পড়ে যাচ্ছিল। ভৈরবের চেয়ে প্রায় চার গুণ দীর্ঘ রেড রিভার প্রস্থে আমার ভৈরবের চেয়ে বেশি নয়। ম্যানিটোবা ইউনিভার্সিটির পেছনে যেখানে রেড রিভারের সাথে আমার সখ্য বাড়ছিল, এই নদী সেখানে সত্তর দশকের ভৈরবের মতোই স্নিগ্ধ এবং শান্ত। অবিরাম বয়ে যাওয়া ছাড়া যেন তার আর কোনো কাজ নেই।
যশোর শহরে ভৈরবের বুকে পাঁচটি সেতু শহরকে উত্তর-দক্ষিণে বেঁধে রেখেছে। উইনিপেগে রেড রিভার বয়ে চলেছে এগারোটি সেতু বুকে নিয়ে।
অনেক দিন আগে বারান্দীপাড়ায় ছোট মামার সাথে বেড়াতে গিয়ে ভৈরবের পাড়ে পিছলে পড়ে জল-কাদায় মাখামাখি হয়ে গিয়েছিলাম ।
মা রাগ করবেন ভেবে ছোট মামা আমার জামা ধুয়ে দু’হাত মাথার ওপর প্রসারিত করে জামার দুই প্রান্ত ব্যানারের মতো ধরে বারান্দীপাড়া সেতুর এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত অসংখ্য বার দৌড়াদৌড়ি করে যখন ফিরে এলেন, তখন তার হাতের জামা শুকিয়ে গেছে, তিনি দরদর করে ঘামছেন । তাকে ওভাবে ঘামতে দেখে আমি বললাম, ‘তুমি তো গোসল করে ফেলেছো!’ মামা মিষ্টি হাসি দিয়ে বললেন, ‘ও কিছু না’ ।
ছোট্ট এই তিনটি শব্দ আমার মনে যে গভীর ছায়া ফেলে গেল, তিনি জানলেনও না। এখনও বিপদ-আপদে এই শব্দ তিনটি আমাকে সাহস দেয়, আশ্বস্ত করে।
সারাহকে নিয়ে রেড রিভারের পাড়ে বেড়াতে গিয়ে এক অদ্ভুত আনন্দে মন ভরে উঠলো। শৈশবের অনেক কিছুই মনে পড়ে গেল। আসলে অন্তর্যামী আমাদের অনেক কিছুই ফিরিয়ে দেন। অন্য কোনোভাবে, অন্য কোনো রূপে।