জিয়াউল হক
, যশোর
‘কত কষ্ট কইরা আমি, কামাই রোজগার করি আনি তবু...’। নিশুতিরাতে গোটা শহর যখন ঘুমিয়ে পড়েছে, নিস্তব্ধ হয়ে এসেছে এই ধরাধাম, তখন আনমনে গানের এ কলিটি গাচ্ছিলেন হুসাইন রিন্টু।
পেশায় নৈশপ্রহরী রিন্টুর প্রতিটি রাত কাটে নির্ঘুম। কখনো বাঁশির হুইসেল দিয়ে, কখনোবা বৈদ্যুতিক পিলার, বাড়ির গেট বা দোকানের শাটারে লাঠি ঠুঁকে জানান দেন, ‘আমি জেগে আছি। আপনারা নিশ্চিতে ঘুমান। রাত জুড়ে আপনাদের জান-মাল আর বিপদাপদের দায়িত্ব আমার।’ সেলক্ষ্যে সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হয়ে কাকডাকা ভোর পর্যন্ত অবিচল দায়িত্ব পালন করে যান তিনি।
শুধু রিন্টুই নন; আসাদ, হাফিজ, মোশাররফ, দেবুসহ অসংখ্য নৈশপ্রহরীর দিনলিপিই একই রকম। যাদের হাতে পরিবার, বাড়ি, প্রতিষ্ঠান, এলাকা তুলে দিয়ে নিশ্চিতে নিদ্রা শহরবাসীর। যাদের হাতে এতো গুরুভার, ‘লঘুপাপে সেই তারাই আবার দণ্ডিত হন। তেমনি পেশাগত প্রতিটা মুহূর্তও থাকে জীবন শঙ্কায়। অথচ তাদের পারিশ্রমিক ন্যূনতম।
ইলিয়াস হোসেন জানান, পাহারার জন্য একটি চেয়ার কিম্বা বেঞ্চই সম্বল তাদের। হাঁটাচলার ফাঁকে জেগে-বসে সেখানেই পুরোটা রাত পার করে দিতে হয় তাদের। দলে আরো লোক থাকলেও দায়িত্ব পালনে একাকিত্বই সঙ্গী হয় তাদের। মাঝে মাঝে হুইসেল বাজিয়ে, হাঁক-ডাক দিয়ে যেমন মনিবকে নিশ্চিন্ত রাখেন, তেমনি দায়িত্ব পালনে অপর সহকর্মীকেও রাখেন সজাগ।
সুবর্ণভূমি টিম পাড়া-মহল্লা, বাড়ি, প্রতিষ্ঠান, মার্কেটে দায়িত্ব পালন করা ২৩ জন নৈশপ্রহরীর সঙ্গে কথা বলেছে। শুনেছে তাদের আবেগ, অনুভূতি, শূন্যতা, চাওয়া-পাওয়ার গল্প।
তাদেরই একজন রবিউল ইসলাম জানান, শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা কিম্বা কালবোশেখিও দমাতে পারে না তাদের। নিজের অসুস্থতা তো দূরের কথা, পরিবার-স্বজনদের অসুখ বা বিপদাপদে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে না পারলেও দায়িত্বের বোঝা ঠিকই কাঁধে চাপে তার। একাকী সে সংগ্রামে একটু পান থেকে চুন খসলেই লাঞ্ছনা-গঞ্জনা আর হয়রানির মুখে পড়তে হয়। কখনওবা মারপিট, এমনকি টানতে হয় জেলের ঘানিও।
উদাহরণ দিতে গিয়ে তিন দিন আগে রাউজানের নৈশপ্রহরী শফিকুল আলমের (৭০) হত্যাকাণ্ডের কথা বলেন। সংবাদপত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে জানান, নিখোঁজের ৩০ ঘণ্টা পর চোখ উপড়ানো অবস্থায় তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
রবিউল জানান, নিরাপত্তার জন্য একটিমাত্র লাঠি আর বাঁশিই তাদের সম্বল। যা দিয়ে দুর্বৃত্তদের মোকাবেলা করতে হয় তাদের। কখনও সফল হন। তবে ব্যর্থতা ফিরে আসে নিদারুণ গ্লানি আর বেদনাদায়ক হয়ে।
রবিউল বলেন, সম্প্রতি যশোর শহরের ঘোপ এলাকার একটি চুরির ঘটনায় অভিযুক্ত করে সেখানকার নৈশপ্রহরীকে মারপিট করা হয়। চুরির অপবাদ দিয়ে চাকুরিচ্যুতি ও জরিমানাও করা হয়।
সেলিম হোসেন নামে আরেক প্রহরী বলেন, ‘এখন আধুনিক যুগ। কিছু একটা ঘটলেই নেটে ছড়িয়ে। কিন্তু সেটা সঠিক না-ও হতে পারে। সে বিবেচনা না করেই নেটে দিয়ে দেওয়া হয়। আমাদেরও তো পরিবার, বউ, ছেলে-মেয়ে আছে। তাদেরকে মুখ দেখাই কেমনে? সত্যি হলে সমস্যা নেই, কিন্তু সবগুলোতো সত্যি না।’
প্রহরী শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘অভাবের জন্যই এ পেশায় আসে সবাই। অনেকেই আবার বয়স্ক। কোনো কাজ পাচ্ছে না। কী করবে তারা? তাই বাধ্য হয়ে পেটের জন্যি আসে। এজন্যি মালিকরাও অত গুরুত্ব দেয় না, কম টাকায় পায়। আমাগেরও কিছু বলার থাকে না।’
শেখ রফিকুলের কথার সূত্র ধরে অন্তত ১৩ জন নৈশপ্রহরী নিশ্চিত করেছেন তাদের বেতন চার থেকে সর্বোচ্চ নয় হাজার টাকা পর্যন্ত। যা দিয়ে এই দুর্মূল্যের বাজারে সংসার চালানোই দায়। আবার রাত জাগার কারণে ঘুম পোষাতে গিয়ে দিনের বেলায় বিকল্প কোনো কর্মসংস্থানের পথও নেই তাদের।
অথচ এই পেশাজীবীদের সক্রিয়তার ওপর নির্ভর করেই গোটা একটি অঞ্চল, এলাকা, প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকে।
কিন্তু সেই পেশাজীবীদের জন্য রাষ্ট্র কিম্বা সমাজের দায়বদ্ধতা কতটুকু?
যশোর পৌরসভার নগর পরিকল্পনাবিদ সুলতানা সাজিয়া জানান, নৈশপ্রহরীদের বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা আপাতত পৌর কর্তৃপক্ষের নেই। স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠানগুলোই তাদের সবকিছুর দেখভাল করে থাকে।
সমাজসেবা অধিদপ্তর যশোরের উপপরিচালক হারুন-অর-রশিদ বলেন, ‘নৈশপ্রহরীরা বয়স্কভাতার নিয়মের আওতায় থেকে আবেদন করলে আমরা তাদেরকে ভাতার বন্দোবস্ত করে দিতে পারবো। এর বাইরে আমাদের তেমন কিছু করার নেই।’
উপজেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. ইয়ারুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন সময়ে আসা ত্রাণ কর্মসূচির অধীনে নিয়ম মেনে আবেদন করলে সহযোগিতা পাওয়া সম্ভব।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপ মহাপরিদর্শক মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘নৈশপ্রহরী সংক্রান্ত কোনো ঘটনা বা অভিযোগ আমাদের কাছে নেই। যেহেতু তারাও শ্রমিক, সুতরাং শ্রম আইনের অধীনে কোনো বিষয়ে অভিযোগ করলে আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।’
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সরকারি কোনো দপ্তরই সুনির্দিষ্টভাবে নৈশপ্রহরীদের নিয়ে কাজ করে না। নেই কোনো নীতিমালাও। ফলে সবার অজান্তেই থেকে গেছে রাতের এ নায়কেরা। দায়িত্বের ভার বহন করেও তারা পাননি স্বীকৃতিটুকুও।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) যশোরের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক শাহীন ইকবাল বলেন, আগে বিদ্যালয়গুলোতে বেতন হতো না। এখন এমপিওভুক্ত, সরকারিকরণ হচ্ছে। আনসার, ভিডিপি, গ্রামপুলিশেরাও স্বীকৃতি পেয়েছেন। বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। নৈশপ্রহরীদের ব্যাপারেও সরকার উদ্যোগ নিতে পারে। এটা তাদের নাগরিক অধিকার।