গণমাধ্যম
আকরামুজ্জামান
ডিজিটাল বিপ্লবের যুগে সংবাদমাধ্যমের কাঠামো বদলে যাচ্ছে দ্রুত। সংবাদ তৈরির কৌশল, পাঠকের আচরণ, তথ্যের উৎস, সবকিছুতেই এসেছে আমূল পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের কেন্দ্রে রয়েছে ডিজিটাল কন্টেন্টের আধিপত্য, যা সংবাদ পরিবেশনকে যেমন গতিশীল করেছে, তেমনি মূলধারার সাংবাদিকতার জন্য তৈরি করেছে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ। দ্রুত তথ্য প্রচারের প্রতিযোগিতা, ভিউ বাড়ানোর চাপ এবং সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব পেশাদার সাংবাদিকতার মৌলিক মূল্যবোধকে নতুনভাবে পরীক্ষায় ফেলছে।
গত কয়েক বছরে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে খবরের গতি এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের আগেই তা ভাইরাল হয়ে যায়। ‘ক্লিক’, ‘ভিউ’, ‘এনগেজমেন্ট’, এই সূচকগুলোই হয়ে উঠেছে অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রধান লক্ষ্য। ফলে তথ্যের গভীরতা, অনুসন্ধানী মনোভাব এবং প্রেক্ষাপট তুলে ধরার মতো সাংবাদিকতার মূল চর্চা ব্যাহত হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমগুলোও পাঠক ধরে রাখতে এই গতিময়তায় বাধ্য হয়ে অংশ নিচ্ছে, যার ফলে কখনো কখনো রিপোর্টিংয়ের মান ও যথার্থতা ঝুঁকির মুখে পড়ে।
এই পরিস্থিতির আরেকটি গুরুতর দিক হলো সাংবাদিকদের নিরাপত্তা। মাঠে কাজ করা বহু প্রতিবেদক প্রতিদিন নানা ঝুঁকির মধ্যে সংবাদ সংগ্রহ করেন, রাজনৈতিক সংঘাত, অপরাধ চক্র, প্রভাবশালী স্বার্থগোষ্ঠী, এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হয়রানি, সবই তাদের জন্য বাস্তব হুমকি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সাংবাদিকদের শারীরিক আক্রমণ, হুমকি, মামলায় জড়ানো এবং পেশাগত স্বাধীনতায় বাধা দেওয়ার ঘটনা প্রায়ই শোনা যায়। ডিজিটাল যুগে ভুল বা অসম্পূর্ণ তথ্য প্রকাশের অভিযোগেও রিপোর্টারদের ওপর সামাজিক চাপ ও ট্রল বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে নিরাপদ পরিবেশে কাজ করা এবং সংবাদ স্বাধীনতা রক্ষা করা সাংবাদিকতার বড় চ্যালেঞ্জ।
এই সংকটের আরেকটি বড় দিক হলো, অনিয়ন্ত্রিত কনটেন্ট নির্মাণের উত্থান। অনেক কনটেন্ট ক্রিয়েটর তথ্য-নির্ভর ভিডিও বা বিশ্লেষণের নামে এমন সব কনটেন্ট তৈরি করছেন, যা সাংবাদিকতার নৈতিকতা, তথ্য যাচাই কিংবা দায়বদ্ধতার মৌলিক মানদণ্ড পূরণ করে না। এতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে যাচাইহীন তথ্য, মতামতকে ‘সংবাদ’ হিসেবে প্রচারের প্রবণতা, আর দর্শকের একটি বড় অংশ বিভ্রান্ত হচ্ছে সহজ-সহজ আবেগি বা নাটকীয় তথ্য পরিবেশনে। ভাইরাল হওয়ার চাপে অনেকেই অতিরঞ্জন, বিকৃতি বা অর্ধসত্যের আশ্রয় নিচ্ছেন, যা পেশাদার সাংবাদিকতার জন্য একটি বড় হুমকি।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সামাজিক অবক্ষয়ের প্রভাব, যা সাংবাদিকতা সংকটকে আরও গভীর করছে। সমাজে অসহিষ্ণুতা, মেরুকরণ, গুজব-নির্ভরতা এবং তাৎক্ষণিক আবেগপ্রবণ প্রতিক্রিয়া বৃদ্ধি সংবাদমাধ্যমের জন্য একটি চ্যালেঞ্জিং পরিবেশ তৈরি করেছে। মানুষ এখন যুক্তির চেয়ে উত্তেজনাকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে, ফলে যেকোনো পক্ষপাতমূলক বা অর্ধসত্য তথ্য খুব সহজেই জনপ্রিয় হয়ে যাচ্ছে। যারা তথ্য বিকৃত করেন বা বিভ্রান্তি ছড়ান, তারা সমাজের এই আবেগ-নির্ভর প্রবণতাকে সুবিধা হিসেবে ব্যবহার করছেন। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সংবাদকর্মীদের ওপরও। তারা মাঠে কাজ করতে গিয়ে নানা চাপ, হুমকি ও হয়রানির সম্মুখীন হন, কারণ সামাজিকভাবে বিরোধিতা বা আক্রমণের প্রবণতা বেড়েছে। বাস্তবে দেখা যায়, সাংস্কৃতিক অবক্ষয় ও অসহিষ্ণুতার কারণে সৎ সাংবাদিকতাকে প্রায়ই ‘চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে দেখা হয়, যা সংবাদ স্বাধীনতার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে।
অন্যদিকে, সাংবাদিকদের পেশাগত নিরাপত্তাও আজ বড় সংকটে। মাঠ পর্যায়ে কাজ করা সাংবাদিকেরা প্রতিদিনই মোকাবিলা করছেন রাজনৈতিক সংঘাত, অপরাধী চক্রের হুমকি, প্রভাবশালী গোষ্ঠীর চাপ ও অনলাইন হয়রানি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রল, কুৎসা রটনা এবং ব্যক্তিগত আক্রমণের ঘটনা বেড়েছে। ভুল বা অসম্পূর্ণ তথ্য প্রকাশের অভিযোগে রিপোর্টারদের ওপর সামাজিক প্রতিক্রিয়া এতোটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে নিরাপদ পরিবেশে কাজ করাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাও পরিস্থিতিকে আরও জটিল করছে। অনেক সাংবাদিকই সম্মানজনক পারিশ্রমিক, স্বাস্থ্যসুবিধা বা বীমা পান না। বিজ্ঞাপন ও রাজস্ব কমে যাওয়ায় অনেক সংবাদমাধ্যমই বেতন দিতে সংকটে পড়ে, যার প্রভাব পড়ছে মাঠপর্যায়ের কর্মীদের ওপর। পর্যাপ্ত আর্থিক সংস্থান না থাকায় অনুসন্ধানী রিপোর্ট করা, তথ্য যাচাই, প্রযুক্তি সংগ্রহ বা মাঠে কাজ করার খরচ যোগানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ফলে মানসম্মত সাংবাদিকতার ক্ষেত্র আরও সংকুচিত হচ্ছে।
অনলাইন বিজ্ঞাপন আয়ের বড় অংশ আন্তর্জাতিক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর হাতে চলে যাচ্ছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম পাঠক ধরে রাখার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত থাকলেও রাজস্ব কমে যাচ্ছে নিয়মিত। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাÑযা সময়, দক্ষতা ও উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ দাবি করে।
তবুও আশার জায়গা রয়েছে। দ্রুত তথ্যের ভিড়েও পাঠক খুঁজে ফেরেন বিশ্বাসযোগ্য উৎস, নির্ভরযোগ্য তথ্য, প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ। বিশ্বজুড়েই দেখা যাচ্ছে, মানসম্মত সাংবাদিকতার প্রতি মানুষের আস্থা এখনও অটুট। এই আস্থা ধরে রাখতে হলে সাংবাদিকদের পেশাগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ন্যায্য পারিশ্রমিক প্রদান, সংবাদমাধ্যমের আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত এবং অপেশাদার কনটেন্ট প্রবাহের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়া জরুরি।
মাঠ পর্যায়ের সাংবাদিকদের একটি বড় অংশ এখনো সম্মানজনক পারিশ্রমিক পান না। অনেকেই চুক্তিভিত্তিক বা খণ্ডকালীন কাজ করেন, যাদের জন্য নির্দিষ্ট বেতন, চিকিৎসা সুবিধা, বীমা বা নিরাপত্তা কাভারেজ থাকে না। অনেক প্রতিষ্ঠান সঙ্কুচিত রাজস্ব ও বিজ্ঞাপন কমে যাওয়ার কারণে নিয়মিত বেতন দিতে সংকটে পড়ে, যার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে মাঠের সাংবাদিকদের ওপর। ফলে সংবাদ সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবহন ব্যয়, প্রযুক্তিগত সরঞ্জাম বা তথ্য যাচাইয়ের সময় ব্যয় করার সুযোগ কমে আসছে, যা সংবাদমানেও প্রভাব ফেলছে।
একই সঙ্গে অনলাইন অ্যালগরিদম-নির্ভর বিজ্ঞাপন রাজস্বের বড় অংশ চলে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের হাতে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো পাঠক ধরে রাখার জন্য প্রতিযোগিতা করলেও আয় কমে যাচ্ছে। এতে মানসম্মত অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাÑযা সময়, দক্ষতা ও উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগের দাবি রাখেÑসেই কাজ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। অনেক গণমাধ্যম অনিচ্ছা সত্ত্বেও সফট কন্টেন্ট, বিনোদন বা ভাইরাল বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
তবু আশার জায়গা হলো, পাঠক এখনও বিশ্বাসযোগ্যতা খোঁজেন। দ্রুত খবরের পাশাপাশি নির্ভরযোগ্য উৎস, প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা, গভীর বিশ্লেষণ এবং তথ্য যাচাই, এসবই পাঠকের কাছে আবার গুরুত্ব পাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী দেখা যাচ্ছে, মানসম্মত সাংবাদিকতার প্রতি মানুষের আস্থা এখনও অটুট। সেই আস্থা ধরে রাখার জন্য প্রয়োজন সাংবাদিকদের পেশাগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, মাঠ পর্যায়ে ন্যায্য পারিশ্রমিক দেওয়া, এবং সংবাদমাধ্যমের আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য কার্যকর নীতি গ্রহণ।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম শিল্পের সামনে তাই এখন দ্বিমুখী পথ, একদিকে ডিজিটাল কন্টেন্টের দ্রুততার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা, অন্যদিকে সত্যনিষ্ঠ, মানবিক, অনুসন্ধানী ও দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার ভিত্তি রক্ষা করা। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার, প্রশিক্ষণ বৃদ্ধি, নীতিগত স্বাধীনতা এবং সাংবাদিকদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তুলতে পারলে এই চ্যালেঞ্জই পরিণত হতে পারে নতুন সম্ভাবনায়। ডিজিটাল যুগের ভিড়ে বিশ্বাসযোগ্য সংবাদই শেষ পর্যন্ত প্রমাণ করবে, সাংবাদিকতাকে কখনোই অপ্রাসঙ্গিক করা যায় না।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী। সভাপতি, সাংবাদিক ইউনিয়ন যশোর