সভ্যতা
ফকির শওকত
সাত দশকের পথ চলা, যাপনে গৃহী, চিন্তায় ফকিরি বা ফেরারি। আপাতত সেখ মুহম্মদ সুলতানে ক্ষণিক থামা। হাজার বছর ধরে জীনানন্দ পথ চলে থেমেছিলেন নাটোরে। তাকে দুর্দান্ত শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন। আমাকে কোনো মানবিক নারী থামায়নি। এস এম সুলতানের পরীরা থামিয়েছে। যারা ফার্স্ট প্লান্টেশনের চারা গাছটিকে পানি দিচ্ছে। মানবসভ্যতার কোনো অথেনটিক ইতিহাস হয় না। এটা শ্রেফ গল্পের উপর দাঁড়িয়ে। পৃথিবীর কৃষিসভ্যতা কোথা থেকে শুরু তা নিয়ে যার যার মতো ইতিহাস চর্চা হচ্ছে।
ইসলাম খ্রিস্ট-ইহুদি মতে হজরত আদম প্রথম মানুষ। কিন্তু তিনি কৃষিকাজ শুরু করেছিলেন-ধর্মগ্রন্থে তা সুনির্দিষ্ট নেই। তাই এস এম সুলতান ছবি আঁকলেন, নাম দিলেন ফার্স্ট প্লান্টেশন। পটভূমি বাঙলা। তিনি দাবি করেননি। কিন্তু গাঙেয় বদ্বীপের একজন গৃহী হিসেবে আমি দাবি করতেই পারি। সুলতানের ফার্স্ট প্লান্টেশনের চুলদাড়িওয়ালা হৃষ্টপুষ্ট মানুষটি আদমেরই প্রতিকৃতি। যিনি এই ব-দ্বীপে চারা রোপণ করে প্রথম কৃষিসভ্যতার সূচনা করেন। পরীরা তাতে আসমান থেকে পানি ছিটিয়ে স্বর্গীয় রূপ দিচ্ছে। এভাবে বলা যায় শরীরী মানুষের কল্পনায় জীন-পরী দেব-দেবীর চরিত্র এঁকে যে গল্প তৈরি হয়েছে, সেটাই সভ্যতা।
এই ব-দ্বীপে যারা এসেছেন তাদের গল্পেও স্বর্গ, মর্ত্য বা দুনিয়া, বেহেস্ত, নরক, দোজখ নির্বাণ সবই আছে। এখানে রাজ্য আছে, রাজপুত্র, রাজকন্যার প্রেম আছে, গল্প আছে। রাজ্য জয় আছে, ক্ষয় আছে। কিন্তু ইতিহাস দলিল-দস্তাবেজ কীর্তিনাশায় অথবা হিমালয়বাহিত পলিমাটিতে চাপ পড়ে আছে। তবে হ্যাঁ, আমাদের চাঁদ সওদাগর, গাজী-কালু-চম্পাবতী, বনবিবি, দক্ষিণ রায়, ফকির মজনু শাহ, ভবানী পাঠক গ্রামেগঞ্জে ছাড়িয়ে থাকা ফকির, পীর-দরবেশদের গল্পই আমাদের সভ্যতা। আরব-পারস্য, তুর্কি-আফগান, মোঘল-হুন, পাঠান-রাজপুত সবাই বাঙলার পলিপানিতে ধুয়ে বাঙালি হয়ে গেছে। সকলের গল্পই আমাদের গল্প। রাম-রাবণ, রামায়ণ-মহাভারত, ইউসুফ-জুলেখা, আরব্য রজনী আমরা সবকিছুরই ওয়ারেশ। রবি ঠাকুর, লালন, নজরুল, জীবনানন্দ, সুলতানের সব সৃষ্টিকর্মই আমাদের পরিচয়।
কীভাবে বাঙলা বা বাঙালি নামকরণ হয়েছে-তা নিয়ে অনেক কথাই হতে পারে। বাঙলা খাড়ি বা বে অব বেঙ্গল বা বাঙালি নদী বঙ্গদেবতা বঙ্গের সাথে ‘আল’ এই যুক্তি ফেলতে পারি না। ব্যবসা, কৃষি এবং কুটিরশিল্পে সমৃদ্ধ এই অঞ্চল পৃথিবীর যেসব মানুষকে এখানে টেনে এনেছে, তারা কেউ ফিরে গেছে কেউ ফেরেনি। তারাই এর ভাষা-সভ্যতা নির্মাণে অবদান রেখে গেছে। কোরআন-বাইবেল, বেদ-ত্রিপিটক-দুনিয়ার সব ধর্মগ্রন্থ এখানে যেমন জায়গা করে নিয়েছে এর লৌকিক বিশ্বাস বা আচারগুলো আবার তাকে আলাদা বৈশিষ্ট্য দিয়েছে। তাই এখানকার ইসলাম, হিন্দুত্ব সহজিয়া মত পৃথিবীর অন্য অঞ্চল থেকে আলাদা। সম্ভবত বাঙলাই সেই জনপদ যেখানে হাজার বছর ধরে বড় দাগে হিন্দু-মুসলমান সমানুপাতিক হারে রয়ে গেছে।
রাজনৈতিক বিভাজন না হলে হয়তো এখনও তাই থাকতো। একাত্তরে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ এবং বাহাত্তরের সংবিধান নিয়ে যারা বিতর্ক তুলছেন বা জুলাই সনদ যদি বাঙালিত্বকে অস্বীকার করে, তাতে বাঙালির হাজার বছরের পথ চলা থামবে না। বাঙলায় ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির রাজনৈতিক বিজয়ের পর বাঙালি জাতির রক্তধারায় যে মিশ্রণ ঘটেছে, তা তাকে স্বকীয় রূপ দিয়েছে। পাঠান, মোঘল, ইংরেজ শাসন আমলে তা উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশ, পশ্চিম বাংলা, ত্রিপুরা, আসাম, বিহার, উড়িষ্যায় বাঙালির বর্তমান বাস।
পৃথিবীর দেশে দেশে এই জনপদের যারা রুটি-রুজির জন্য সংগ্রাম করছে, তারা সবাই বাঙালি। আমাদের বাংলাদেশ তাদের স্বপ্নের প্রথম আধুনিক স্বাধীন রাষ্ট্র। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে যার জন্ম। বাহাত্তরের সংবিধানের চার স্তম্ভের একটি সেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ। যেখানে অন্য জাতিকে অস্বীকার করা হয়নি। পৃথিবীর চল্লিশ কোটি বাঙালির গর্ব এই স্বাধীন বাংলাদেশ। সব জাতি-ধর্ম বিশ্বাসের মানুষ যেমন এখানে ছিল, তেমনি থাকবে। তাই তাদের সকলের পরিচয় নিয়েই সংবিধানে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ সংযোজিত হয়েছে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে। এর মানে এই নয় যে, তাতে বাঙালির হাজার বছরের পথচলাকে অস্বীকার করা হয়েছে অথবা বিশেষ কোনো সম্প্রদায়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক বিভাজন সম্ভব কিন্তু বাঙালির আত্মিক বিভাজন সম্ভব নয়। দ্বিজাতিতত্ত্বে নতুন রাষ্ট্র হতে পারে কিন্তু নতুন জাতি হতে পারে না। লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়ে ১৯৭১ সালে সেই কথা প্রমাণ করেছে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক