যশোর, বাংলাদেশ || রবিবার, ৭ ডিসেম্বর ২০২৫
Subornovumi Subornovumi Subornovumi Subornovumi Subornovumi Subornovumi
Ad for sale 870 x 80 Position (1)
Position (1)
Ad for sale 870 x 100 Position (1)
Position (1)

সাহিত্য

মহাকবিতার পথে

দারা মাহমুদ

প্রকাশ : শনিবার, ৬ ডিসেম্বর,২০২৫, ০৩:৩৫ পিএম
মহাকবিতার পথে

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘চে তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।’ সেরকম কবি আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, আবদুল মান্নান সৈয়দ, রফিক আজাদ সর্বশেষ কবি আল মাহমুদের মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়। কিন্তু কেনো এই অপরাধ বোধ সে উত্তর আমার জানা নেই। তবে কেনো বাংলাদেশের কবিরা বেশিদিন বাঁচেন না, কেনো তারা কবি অরুণ মিত্রের মত ৯০ বছর আয়ু পান না, সেই ক্ষেত্রে এদেশের সামান্য কবিতাকর্মী হিসেবে আমি কি কিছু করতে পারতাম? হয়ত পারতাম না, কিন্তু কেনো পারতাম না- সেই ভাবনাই আমাকে অপরাধী করে দেয়। যে অপরাধবোধের কোন মানেই হয় না। রাষ্ট্রের হাত অনেক বড়, রাষ্ট্র ইচ্ছে করলে কবিকে আরো কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারে। এদেশের কবিদের মৃত্যু ভাগ্য খুব একটা ভাল নয় একমাত্র সৈয়দ শামসুল হক ছাড়া। কবি শামসুর রাহমান মারা গেলেন যখন বিএনপি ক্ষমতায়, আর আল মাহমুদ মারা গেলেন যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, সুতরাং মৃত্যুত্তোর রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য এদের ভাগ্যে সেইভাবে জোটেনি, শুধুমাত্র এটা জুটে গেছে সৈয়দ শামসুল হকের ক্ষেত্রে। একেবারে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শোক জানানো, সর্বোচ্চ সম্মান জানানো সবই জুটেছিল সৈয়দ হকের ক্ষেত্রে এবং সেটা রাজনৈতিক বিবেচনায়। শামসুর রাহমান মারা গেলে ‘মহাকবিতার পথে’ নামে আমি একটা নিবন্ধ লিখেছিলাম দৈনিক ইত্তেফাকে। ১৩ বছর পর আল মাহমুদ মারা গেলে ‘মহাকবিতার পথে-২’ লিখছি এবং তখনও লিখেছিলাম এখনো লিখছি, কবির মৃত্যুর সাথে রাষ্ট্র কি আচরণ করলো, তাতে কবির কিছু আসে যায় না। কবি বেঁচে থাকেন তার কবিতায়, পাঠকের ভালোবাসায়।

মানব জীবনের সবচে বড় দুটো ঘটনা, জন্ম এবং মৃত্যু যাতে মানুষের কোনো হাত নেই। এটা স্রষ্টার বিষয়। শুধু বেঁচে থাকা মানুষরা জন্মে আনন্দ আর মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করতে পারে। শোকগ্রস্ত হতে পারে। কবি আল মাহমুদ জন্মেছিলেন ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোড়াইল গ্রামে। আর আমার জন্ম ১৯৫৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর যশোর শহরে। আমাদের দু’জনের দেখা হয়েছিল ১৯৮৩ সালে যশোর সাহিত্য সম্মেলনে। তখন আল মাহমুদের বয়স ৪৭ বছর আর আমার ২৫ বছর। তখনো তার শরীর বেশ শক্ত আর মন তরুণ, আর আমাকে তো তরুণ কবিই বলা হত। সেই পরিচয় থেকে বেশ ঘনিষ্ঠতা। অবশ্য ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণের জন্য এই লেখা নয়, কারো মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে নানান কিছু স্মৃতিচারণ করা আমার উদ্দেশ্য নয়, সেটা আমি তাঁর জীবদ্দশায় লিখেছি, যা আমার অন্য লেখায় আছে। এই লেখার উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদের কবিদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যে মহাকবিতার জন্ম হয়- তাই।

নরওয়ের লেখক নুট হামসুনের হাঙ্গার উপন্যাস পড়ে লেনিন বলেছিলেন, এ তো ফ্যাসিস্ট। সত্যি সত্যি যখন মহাযুদ্ধ শুরু হল তখন দেখা গেল হামসুন ফ্যাসিস্ট দলে নাম লিখিয়েছেন। ফ্যাসিবাদ সমর্থন করেছিলেন কবি এজরা পাউন্ডও। ফ্যাসিবাদের উদ্ভব হয়েছিল উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই গণহত্যাকারীদের সমর্থন করা যায় না। কিন্তু যুদ্ধোত্তরকালে ফ্যাসিবাদ সমর্থনকারী কবি লেখকদের বাতিল করা হয়নি। কারণ কবি লেখকরা মূল্যায়িত হন তাদের লেখার গুরুত্ব অনুযায়ী। সব সৃজনশীল মানুষের দুটো জীবন থাকে, এক হচ্ছে তার ব্যক্তিজীবন, অন্যটা তার সৃজনশীল জীবন। রিলকে তার বৈবাহিক জীবনকে ভেঙে দিয়ে, নিজের সদ্যজাত কন্যাকে মামা বাড়ি ফেলে রেখে গ্রাম থেকে প্যারিস চলে এসেছিলেন কবি হওয়ার জন্য। পিকাসো তার অসুস্থ সঙ্গিনী ফ্রাঁসোয়া জিলো-র গালে জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়েছিলেন। এগুলো সবই ঘৃণ্য কাজ যা তাদের ব্যক্তিগত জীবনের অংশ। তাই বলে কি এদের কবিতা, চিত্র কর্ম অস্পৃশ্য হয়ে গেছে। কখনোই নয়।

কবি শামসুর রাহমান, আল মাহমুদের জৈবিক সত্তা এখন এই ইহজগত থেকে চলে গেছে অনেক দূরে। কিন্তু তারা যে সৃজনভাণ্ডার রেখে গেছেন তা কি কখনো আমাদের ছেড়ে যাবে? বাংলাদেশে আজ যে শিশু জন্মাচ্ছে, যে শিশু লেখাপড়া শিখে ‘বড়’ হবে, সেরকম ‘বড়’ কাউকে কি পাওয়া যাবে যে শামসুর রাহমান আল মাহমুদ পড়েনি। ‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ / দুপুর বেলার অক্ত/বৃষ্টি নামে বৃষ্টি কোথায়? রকতের রক্ত।’ অথবা ‘আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে/হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।’ এইসব বহুব্যঞ্জনাময় পংক্তিমালা পড়বে না অথচ শিক্ষিত বড় মানুষ হবে, তা কি হয়? ‘সোনার দিনার নেই দেনমোহর চেয়ো না হরিণী/ যদি নাও দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দু’টি/ আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনকালে সঞ্চয় করিনি/ আহত বিক্ষভ করে চারিদিকে চতুর ভ্রুকুটি: চিরন্তন বাংলার আত্ম থেকে উৎসারিত এসব পংক্তিমালা বাঙালি যতদিন থাকবে, বাঙালির সাথে সাথে থাকবে।

কেনো আমাদের দেশের বড় বড় কবি লেখকরা শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক আনুকূল্যের কাছে নতজানু হন, তা আমার বোধগম্য নয়। আমি মনে করি কবি লেখকদের রাজনীতির কোলাহল থেকে একটু দূরে থাকা উচিত। তবে কবিরা রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট হতে পারবেন না, এমন কোন কথা নেই। পাবলো নেরুদা, নাজিম হিকমত, মায়াকোভস্কি তো রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। কিন্তু বাংলার কথা আলাদা। যার পদ্য ছাড়া একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন হয় না, তার মৃতদেহ শহীদ মিনার স্পর্শ করতে পারবে না এটা শুধু বাংলাদেশেই সম্ভব। রবীন্দ্রনাথ বড় কষ্টেই লিখেছিলেন, ‘সাত কোটি বাঙালিরে মা রেখেছো বাঙালি করে, মানুষ করোনি।’

কবি আল মাহমুদ তার আল মাহমুদের কবিতা শীর্ষক গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘আমি লিখতে শুরু করি মধ্য পঞ্চাশ অর্থাৎ ১৯৫৪-৫৫ সালে। তখন আমার মতো আন্দোলনহীন কবিদের পাত্তা পাওয়ার কোন উপায় ছিল না। তবুও কবিদের ভাগ্যে যা ঘটে কিছু পাঠক আর বিচিত্র ধরনের কিছু প্রশংসা জুটেই যায়, আমার ভাগ্যও তার বিপরীত নয়। কবিতা রচনার বেলায় আমি নিজের জন্য একটা সুবিধামত ভাষা তৈরি করতে গিয়ে আঞ্চলিক শব্দরাজির সন্ধান পাই। এই শব্দ সম্ভার জীবন্ত এবং বহমান। খুব ব্যাপকভাবে না পারলেও আধুনিক বাংলা ভাষার গতি প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রচুর শব্দরাজী আমি আমার রচনায় ব্যবহার করে পরিতৃপ্ত।’ (আল মাহমুদের কবিতা, আধুনিক প্রকাশনী, ১৯৮০) কবি আল মাহমুদ-এর বিশাল রচনাসম্ভার থেকে যে সামান্য অংশ তুলে ধরা হল, তাতেই আল মাহমুদের প্রকৃতি পরিচয় পাওয়া যায়। কেউ কেউ ভাবেন গ্রামীণ উপদান সমৃদ্ধ কবিতা এক সময় ফিকে হয়ে যাবে, তাদের সেই ধারণা ভুল প্রমাণ করেছেন জীবনানন্দ দাস আল মাহমুদের ক্ষেত্রে সেটাই প্রযোজ্য হবে। কারণ এ দু’জনই গ্রামীণ উপদান নিয়েছেন গ্রাম্যভাবে নয়, গ্রামীণভাবে। বাংলার আত্ম থেকে যে কবিতা উঠে আসে তার মৃত্যু নেই। সেই কবিরও মৃত্যু নেই। ‘ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় কবির অসহায়তা ও জীবিকার অনিশ্চয়তা অন্যান্য কবির মত আমাকেও কোথাও স্থিরভাবে দাঁড়াতে দেয়নি’ (ঐ) এই বক্তব্যের মধ্যেই হয়ত আল মাহমুদের প্রকৃতি অনেকটা প্রকাশিত। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কোন কোন কবি মহাকবিতার জন্ম দেন, সেটা জীবনানন্দ দাস, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। মৃত্যুতে কে শোক জানালো আর কে জানালো না, সেটা বড় কথা নয়। কবির জায়গা অনেক উপরে। পাঠকের ভালোবাসা তাকে এমন এক উচ্চতায় পৌঁছে দেয়, সেই উচ্চতা ছুঁতে গেলে অনেক উঁচু হতে হয়। আর এভাবেই কবির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মহাকবিতার জন্ম হয়।

লেখক : কবি ও সাংবাদিক
২১.০২.২০১৯

ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

Ad for sale 270 x 200 Position (2)
Position (2)